shono
Advertisement

কখনও নিজের স্ত্রী, কখনও মেমসাহেব, নানা রূপে দেবীকে সাজাতেন রবি ঠাকুরের ঠাকুরদা!

সেকালের কলকেতায় 'ব্রাহ্ম' ঠাকুরবাড়ির পুজো নিয়ে চালু ছিল নানা গল্পকথা।
Posted: 05:52 PM Oct 21, 2023Updated: 12:29 PM Oct 22, 2023

বিশ্বদীপ দে: সে এক ভিন্ন সময়। ভিন্ন কলকাতা। বলা ভালো কলকেতা। তার কেতাই আলাদা। এই ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে তাকে একটা ভিন্ন পৃথিবীই মনে হতে পারে। জমিদারবাড়িগুলির দুর্গাপুজো, দশমীর নীলকণ্ঠ পুজো ওড়ানো, বিরাট ভোগের আয়োজন- সমারোহ, আড়ম্বরে তা সত্যিই চমকে দেয়। জানেন কি, এই তালিকায় বাদ ছিল না জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িও। হ্যাঁ, ব্রাহ্ম হয়েও ঠাকুরবাড়িতে বন্ধ ছিল না দুর্গাপুজো। তারও আগে দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে সেপুজোর আয়োজন ছিল দেখবার মতো। যদিও শেষ পর্যন্ত বন্ধই হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের পরিবারের দশভুজার আরাধনা। কিন্তু ইতিহাস এখনও উৎসবের মরশুমে হারিয়ে যাওয়া কলকাতার বুক থেকে তুলে আনে সেই সব দিন।

Advertisement

১৭৮৪ সালে দুর্গাপুজো শুরু হয় ঠাকুরবাড়িতে। ততদিন পর্যন্ত পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুজোই পরিচিত ছিল ঠাকুর পরিবারের পুজো হিসেবে। কিন্তু ওই বছর থেকে নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকোয় প্রথমবার দুর্গাপুজো (Durga Puja) করলেন। যদিও ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো শহরের সকলকে তাক লাগিয়ে দেয় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে। সে এক এলাহি আয়োজন।

[আরও পড়ুন: অসুস্থকে নিয়ে ‘মা’ উড়ালপুলে উঠল রিকশা, প্রশ্নের মুখে ট্রাফিক নজরদারি]

দ্বারকানাথ ঠাকুর (Dwarkanath Tagore) ততদিনে বিপুল ধনসম্পদের মালিক। বিত্তশালী মানুষটির সঙ্গে ইংরেজদের রীতিমতো ওঠাবসা। দর্পনারায়ণের পুজোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা ছিল। তাই ক্রমেই জাঁকজমক বাড়তে থাকে জোড়াসাঁকোর দুর্গাপুজোর। বলতে গেলে গোটা কলকাতার পুজোর ‘নিউক্লিয়াস’ হয়ে ওঠে ওই পুজো। আড়ম্বর-আয়োজনে তা তাক লাগিয়ে দিত। পরবর্তী সময়ে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় আমরা পাই, ‘দুর্গোৎসব মহাসমারোহে সম্পন্ন হত। আমাদের উঠানের উপর সামিয়ানা খাটানো আর তিন দিন ধরে নৃত্যগীত আমোদ প্রমোদ, আমাদের আনন্দের আর সীমা থাকত না।’ যদিও এটা অনেক পরবর্তী সময়ের বর্ণনা। দ্বারকানাথ ঠাকুরের যৌবনকালের আড়ম্বর ছিল আরও অন্যরকম।

সেই পুজোয় শামিল ছিলেন সাহেবসুবোরাও। ছিল নানা আয়োজন। নাচ-গান-ভোজন-খাওয়াদাওয়া… এমনকী, এমনও গুঞ্জন সেই সময় শহরের থিয়েটার মাতানো ইংরেজ অভিনেত্রী এসথারের অনুরাগী ছিলেন দ্বারকানাথ। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুরোনো সেই পুজোর কথা’ বইয়ে রয়েছে সেই কুড়ি-বাইশের তরুণীর মুখের সঙ্গেই একবার মিলে গিয়েছিল দুর্গাপ্রতিমার মুখ! সেবারের পুজোয় তা নিয়েই কত কথা! কিন্তু খোদ প্রিন্সের সমালোচনা করবে কে। তাছাড়া ব্যাপারটা তো গুজবের সীমানার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে! তবে ভিতরে ভিতরে আলোচনা জোরকদমে চলেছিল নিশ্চয়ই। আবার একবার শোনা গিয়েছিল দ্বারকানাথের বিদূষী স্ত্রী দিগম্বরীর সঙ্গে মিল পাওয়া গিয়েছিল প্রতিমার মুখের!

[আরও পড়ুন: মাকে খুন করে আত্মহত্যার নাটক! গল্প ফেঁদেও শ্রীঘরে ‘গুণধর’ ছেলে]

কিন্তু ক্রমে বদলে গেল দিন। দ্বারকানাথ-দিগম্বরীর পাঁচ সন্তানের দুজন অল্পবয়সেই মারা যায়। বাকি তিনজনের অন্যতম দেবেন্দ্রনাথ। দুই ভাই গিরীন্দ্র ও নগেন্দ্র তাঁর অনুরক্ত ছিলেন। একবার সন্ধিপুজোর সময় দ্বারকানাথ দেখতে পান ছেলেরা কেউই ঠাকুরদালানে নেই। পরে ডাক দিতে সকলে এলেও দেবেন ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হননি মা দুর্গার সামনে। আসলে ততদিনে ব্রাহ্ম আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন দেবেন্দ্রনাথ। ফলে অচিরেই দেখা গিয়েছিল দুর্গা থেকে জগদ্ধাত্রী সব পুজোই হচ্ছে একদিকে। বাড়িরই অন্যদিকে কিন্তু পুজো নেই।

১৮৪৬ সালে লন্ডনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো তখনও চলছে। তা পাকাপাকি বন্ধ হয় ১৮৫৮ সালে। দেবেন ঠাকুরের দুই ভাই পুজোর আয়োজন করতেন। কিন্তু সেই বছর নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হলে আর পুজো হয়নি ঠাকুরবাড়িতে। তারও আগে যখন পুজো চলতও, তখন দেবেন্দ্রনাথ পুজোর সময় চলে যেতেন হিমালয়ে। নিরাকার ব্রহ্মের আরাধনায় ব্রতী হতেন তিনি। বলা যায়, বাড়িতে জাঁকজমক করে পৌত্তলিকতার চর্চা মেনে নিতে না পেয়ে এ একপ্রকার পলায়ন। সেই অস্বস্তির শেষ রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) জন্মের আগেই। শতকেরও সিকি ভাগ কম সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো চলেছিল। যা ছিল কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ। এখানে বলে রাখা ভালো, জোড়াসাঁকোর পুজো বন্ধ হয়ে গেলেও পাথুরিয়াঘাটার পুজো কিন্তু চলেছিল দিব্যি। কিন্তু সেই পুজোয় জোড়াসাঁকোর বৈভব ছিল না।

বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও দ্বারকানাথের আমলের পুজো নিয়ে চর্চা ছিল। ক্রমে তা থেকে যায় ইতিহাসের গর্ভেই। তবে একটা সময় পর ইতিহাসের অধ্যায় পরিণত হয়ে যায় গল্পে। আজ কান পাতলে এই ঝাঁ চকচকে থিমসর্বস্ব কলকাতার বুকে শুনতে পাওয়া যায় সেই প্রিন্স ঠাকুর আয়োজিত দুর্গাপুজোর কথা। বিসর্জনের সময় ওড়ানো হচ্ছে নীলকণ্ঠ পাখি। তেতলার ছাদ থেকে মহিলারা উঁকি মেরে দেখছেন বিজয়া। ওই একবারই নাকি তাঁরা ছাদে উঠতে পারতেন। অসংখ্য অলঙ্কারশোভিতা দুর্গা জলে পড়তেই শুরু হত আলোড়ন। দেবীর গায়ের বহুমূল্য গয়না নিতে শুরু হত প্রতিযোগিতা। যার একেকটির মূল্যই যে বিপুল।

ইতিহাস-রসিকরা এখনও কান পাতলে, চোখ তুলে তাকালে সেকেলে কলকাতার সেই সব ইতিহাসকে চোখের সামনে ফুটে উঠতে দেখেন। বার বার ইতিহাস বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের সত্যের গায়ে গল্পের এমন সোনালি রং এসে লাগে তখন তা হয়ে ওঠে আরও মনোরম। সেই সব গল্পকথা আজও, এই সময়ে দাঁড়িয়েও আমাদের মনে করিয়ে দেয় অনেকটা দূর হেঁটে চলে এসেছি আমরা। তবু চাইলে দিগন্তের দিকে তাকালে এখনও সেই ফেলে আসা সময় উঁকি মেরে যায়। যা আসলে রয়েই গিয়েছে বাতাসের ভিতরে। কেবল তাকে উপলব্ধি করাটুকুই বাকি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement