সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: রূপকথার গল্প যদি সত্যি হয়, কেমন হয় তাহলে? সেই রূপকথার গল্প-ই এবার বাংলার পর্যটনে। গল্পের ‘হবিট হাউস’ রূপ পেয়েছে ‘হবিট ট্যুরিজিম’-এর। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়তলির বাঘমুন্ডির সোনকূপিতে। যা বাংলায় প্রথম।
ইংরেজ লেখক জে আর আর টলকিন-এর গল্প ‘লর্ড অফ দ্য রিং’। এই গল্পের কিছু চরিত্র ‘হবিট হাউস’-এ বাস করত। সেই ‘হবিট হাউস’ অবশ্য বাস্তবে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের হ্যামিলটনের কাছে মাটামাটায়। ওই রূপকথার গ্রাম, এক টুকরো মাটামাটা যেন উঠছে এসেছে পুরুলিয়ার অযোধ্যার পাহাড়তলিতে। ব্যাপারটা কী?
অভিধান ঘাঁটলে ‘হবিট হাউস’ কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় না। গল্পে ব্যবহৃত এই শব্দ আদতে পাতাল ঘর। যে বাড়ি মাটি দিয়ে ঢাকা। যেখানে এয়ার ইনসুলেশন কাজ করবে। যা পুরুলিয়ার প্রখর দাবদাহ থেকে বাঁচাবে। প্রয়োজন হবে না এসি বা বাতানুকূল যন্ত্র। আর ভাবনাটা এখান থেকেই শুরু। সেই পরিবেশবান্ধব পর্যটন প্রকল্প ‘হবিট ট্যুরিজম’ চোখ টানছে একেবারে অযোধ্যা পাহাড়ের নিচে বাঘমুন্ডির মাঠা বনাঞ্চলের সোনকূপিতে। বলরামপুর- বাঘমুন্ডি সড়কপথে সোনকূপি মোড় থেকে ২ কিমি দূরে।
[আরও পড়ুন: ‘মোদিজি বলে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন না, আমি শুধুই মোদি’, বলছেন প্রধানমন্ত্রী]
এই অভিনব পর্যটন প্রকল্পে আপাতত ‘হবিট রুম’ রয়েছে সাতটি। সেই রুমের সঙ্গেই রয়েছে অ্যাটাচ ওয়াশরুম। এছাড়া রয়েছে ১৫ টি ‘হবিট টেন্ট’। তবে ওই তাঁবুগুলো নন অ্যাটাচ ওয়াশ। তাঁবুর জন্য রয়েছে আলাদা সাধারণ ব্যবস্থা। আছে খাওয়াদাওয়ার রকমারি আয়োজন। তবে এই ট্যুরিজমের সাইট সিয়িংগুলো একেবারেই ভিন্ন। এই পর্যটন প্রকল্প সাধারণ সাইট সিয়িং-এ খুব একটা জোর দেয় না। তাদের থিম বা ভাবনাটা হচ্ছে টেকিং, এক্সপ্লোরেশান। আসলে প্রকৃতির সমস্ত স্বাদ শুষে নিতে তাঁরা রাতে হেড ল্যাম্প লাগিয়ে জঙ্গল ট্রেলের ব্যবস্থা রেখেছেন। ব্যবস্থা রয়েছে রক ক্লাইম্বিং, ফিশিং, ট্রেকিং, কেভিং, মেডিটেশন, ক্যাম্প ফায়ার, নেট ক্লাইম্বে মেতে ওঠার।
এছাড়া তুরস্কের সেই মধ্যযুগীয় রান্নাঘরের স্টাইলে বারবিকিউ। সেই সঙ্গে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া পুরুলিয়ার লোকনৃত্য ছৌ। ওই ‘হবিট ক্যাম্প’ থেকেই আসাযাওয়া-সহ ঘুরে দেখা মোট ৩ ঘন্টা হেঁটে ডাউরি নালা ট্রেক করানো হচ্ছে। ২ ঘন্টা ধরে বাদলিধাঁধির গুহায় এক্সপ্লোরেশান। ক্যাম্প ফায়ারে-র প্রকৃত স্বাদ দিতে জঙ্গলের শুকনো কাঠ সংগ্রহ করিয়ে সচেতনতার পাঠ দিয়ে বন ফায়ার। রয়েছে ‘হবিট ক্যাম্পাস’-র মধ্যেই ছিপ দিয়ে পুকুরের মাছ ধরার ব্যবস্থা। মন চাইলে একেবারে সাতসকালে ওই প্রকল্প লাগোয়া বড় আড়ালকানালির পাহাড় চূড়োয় মেডিটেশনও করা যাবে। রাতে হাতির গতিবিধি দেখেই গ্রামের মানুষজনের সাহায্য নিয়ে হচ্ছে জঙ্গল ট্রেল। এই কাজে স্থানীয়দের হাতে অর্থ আসছে। সর্বোপরি এই পর্যটন প্রকল্পের গাইড স্থানীয়রাই।
[আরও পড়ুন: অযোধ্যায় নয়া অ্যাডভেঞ্চার বাইক রাইড! শুধু বেড়ানো নয়, গল্পও শোনাচ্ছেন রাইডাররা]
সবে মিলিয়ে এই ‘হবিট ট্যুরিজম’ শুধু পরিবেশবান্ধব নয়। গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থারও বদল ঘটাচ্ছে। এই অভিনব পর্যটন প্রকল্পের কর্ণধার হাওড়ার বাসিন্দা বরুণদেব ভট্টাচার্য বলেন, “রূপকথার গল্পকে পর্যটনে বাস্তবে রূপ দেওয়ার আগে ২০১৬ থেকে ভাবনার জমি তৈরি করতে প্রথমে পর্যটকদের ন্যূনতম সুবিধা এবং অ্যাডভেঞ্চারের আবহ দিয়ে পুরুলিয়ার বুকে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। পরীক্ষামূলকভাবে দেখতে চেয়েছিলাম বাংলার পর্যটকরা গ্রহণ করেন কিনা। এই কাজে পুরোপুরি সফল না হলেও কিছুটা জমি তৈরি করা। এরপর গাছ বাড়ি। এটা তৈরি করার পর সফলতায় বলা যায় ৮০ শতাংশে পৌঁছে যাই। আসলে কোনওটাই সেই অর্থে ১০০ শতাংশ পরিবেশবান্ধব নয়। কিন্তু এবার সেই কাজকে সম্পূর্ণভাবে সফল করতেই পুরুলিয়ার গরমের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য এই ভাবনার অবতারণা।” তাই প্রকল্প কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত, পুরুলিয়ার গরমে বা বর্ষার রূপ দেখতে এই ‘হবিট হাউস’-এ ভিড় হবেই। নতুন বছরের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি এই পাতাল ঘরে হবে অ্যাডভেঞ্চার ফেস্টিভ্যাল। তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এখন থেকেই।
আসলে একটা বড় অংশের পর্যটক রয়েছেন যাঁরা পরিবেশ সচেতনতাকে প্রাধান্য দেন। তাঁরাই যে এই প্রকল্পের ‘টার্গেট গেস্ট’ তা পরিষ্কার। আসলে পর্যটন তখনই সফল। যখন পরিবেশ অক্ষত থাকে। তাই এই ফ্যান্টাসি স্টে-র পাতাল ঘরে কানে কানে কথা বলবে ছোটবেলার রূপকথারা। সেই রূপকথায় ডুবে হারিয়ে যেতে পারেন এই ‘হবিট ট্যুরিজম’-এ।