লোকসভা ভোটে সাফল্য পেতে গেলে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ইসু্যগুলির উপর ভরসা করতে হবে। মোদির ভাবমূর্তি, হিন্দুত্ব, ৩৭০ ধারা বিলোপ– এই তিন হাতিয়ারকে মোকাবিলা করতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পরবর্তী বৈঠকে রাজ্যভিত্তিক ইসু্যই হোক প্রচারের কৌশল। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পরবর্তী বৈঠকে লোকসভা ভোটে প্রচারের ইসু্য নিয়ে আলোচনা হবে। কীভাবে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপিকে মোকাবিলা করা হবে, তার কৌশল নিয়ে কথা বলবেন নেতারা। নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক গুরুত্বর বিচারে এই বৈঠক এক অন্য মাত্রায় পৌঁছবে। পঁাচ রাজে্যর ভোটের ফল থেকে শিক্ষা নিয়েই যে নেতারা কৌশল রচনা করবেন, তা বলা বাহুল্য।
লোকসভা ভোটে সাফল্য পেতে গেলে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ইসু্যগুলির উপরই ভরসা করতে হবে। পঁাচ রাজে্যর ভোটের ফলের যদি কোনও শিক্ষা বিরোধীদের জন্য থেকে থাকে, তাহলে এককথায় এটাই। লোকসভা ভোটেও বিজেপির প্রচারের মূল হাতিয়ার হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি। এর সঙ্গে বিজেপির মূল আদর্শগত ইসু্য হিন্দুত্ব তো রয়েইছে। এছাড়া কিছু খয়রাতি থাকতে পারে। ২২ জানুয়ারি রাম মন্দিরের উদ্বোধন হবে। রাম মন্দিরের আবেগকে দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রবল চেষ্টা হবে। যে-কাজ ইতিমধে্যই শুরু হয়ে গিয়েছে। ৩৭০ ধারা বিলোপ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সামনে এসে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে সামনে রেখে যে বিজেপি লোকসভা ভোটে একটা ব্যাপক প্রচারে নামবে, তা ২৪ ঘণ্টাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাম মন্দির ও ৩৭০ ধারা বিলোপ– হিন্দুত্বর এই দুই অস্ত্রেই বিজেপি শান দিতে তৈরি।
[আরও পড়ুন: এবার বাইডেনের বিরুদ্ধে শুরু ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া, চাপ তৈরির কৌশল ট্রাম্পের দলের?]
এর সঙ্গে লোকসভা ভোটের প্রচারের আগে যোগ হয়ে যাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিল যে কোনও সময় উত্তরাখণ্ডের বিধানসভায় পাস হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিজেপি পাইলট প্রোজেক্ট হিসাবে উত্তরাখণ্ডকেই বেছে নিয়েছে। মোদির ভাবমূর্তি ও হিন্দুত্বর এই তিন হাতিয়ার– একে মোকাবিলা করেই লোকসভা ভোটের প্রচারে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে অগ্রসর হতে হবে। নিশ্চিত করেই কাজটা সহজ নয়। পঁাচ রাজে্যর ভোটের প্রচারেই ‘মোদি গ্যারান্টি’ নাম দিয়ে মোদির ভাবমূর্তি প্রচারের বিষয়টি সামনে এসে গিয়েছে। জাতীয় স্তরেও ‘মোদি গ্যারান্টি’ নিয়ে বিজেপি প্রচার শুরু করে দিয়েছে। পঁাচ রাজে্যর বিধানসভা ভোটে ‘মোদি গ্যারান্টি’-র মোড়কে খয়রাতির ঘোষণাগুলি হয়েছে। মোদির ভাবমূর্তির বিপ্রতীপে ইন্ডিয়া জোট কোনও মুখকে নিয়ে আসতে গেলে যে পঁাচ রাজে্য হয়ে যাওয়া ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
বিজেপিও ইন্ডিয়া জোটকে সেই ফঁাদে ফেলতে চায়। সরকারিভাবে ইন্ডিয়া জোটের পক্ষ থেকে যে কোনও মুখকে সামনে আনা হবে না, তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, তাদের সব নেতা সচেতনভাবেই হোক, অথবা অবচেতনে গান্ধী পরিবারের মুখকে সামনে নিয়ে চলে আসেন। রাহুল গান্ধী ঠিক করে রেখেছেন তঁার ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত করবেন। দ্বিতীয় পর্বটি পূর্ব থেকে পশ্চিম ভারতে হওয়ার কথা। পঁাচ রাজে্যর ফলের পর এই যাত্রা স্থগিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এই যাত্রা শুরু হলে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাহুলকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসাবে তুলে ধরা শুরু হয়ে যাবে। গান্ধী পরিবারের তোষামোদ করা কংগ্রেসের সংস্কৃতিতে রয়েছে। কংগ্রেস নেতারা অবশ্য সাফাই দেন, একমাত্র গান্ধী পরিবারের নামেই দলটা ঐক্যবদ্ধ হয়। বিজেপিও চাইছে সেরকমটাই ঘটুক। লোকসভা ভোটের প্রচারেও যদি কোনওভাবে লড়াইটা ‘মোদি বনাম রাহুল’ হয়ে যায়, তাহলে খুব সহজেই বিজেপি সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছতে পারে।
[আরও পড়ুন: এবারে মধ্যপ্রদেশে নিষিদ্ধ মাছ-মাংস-ডিম বিক্রি! মসনদে বসেই বিতর্কে মোহন যাদব]
‘ইন্ডিয়া’ জোটকে লোকসভা ভোটের ইসু্য ও প্রচার কৌশল নিয়ে আলোচনার সময় এই জায়গাটাতেই সতর্ক থাকতে হবে। পঁাচ রাজে্যর ভোটের ফল বলছে, বিজেপির সঙ্গে লড়াইটা যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং রাজ্যভিত্তিক ইসু্যতে সীমিত রাখতে পারলে বিরোধীদের সুবিধা। মিজোরামের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, লড়াইটা যখন রাজে্যর ইসু্যতে হচ্ছে, তখন সেখানে বিজেপির কোনও জায়গাই নেই। মিজোরামের ভোটে এবার প্রধান দুটো ইসু্য ছিল– প্রতিবেশী মণিপুরের জাতিদাঙ্গা এবং মায়ানমারের শরণার্থী সমস্যা। এই দুটো সমস্যাই স্থানীয় সমস্যা। এই দুই ইসু্যতে লড়াই হয়েছে ‘জোরাম পিপল্স মুভমেন্ট’ এবং ‘মিজো ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট’ নামে দুটো অাঞ্চলিক দলের। কংগ্রেস ও বিজেপির মতো জাতীয় দল কার্যত মাঠের বাইরে চলে গিয়েছে।
তেলেঙ্গানার ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে, কেসিঅার-এর দল ‘তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি’ থেকে ‘ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি’ হতে গিয়েই পরাজিত হয়েছে। সবাইকে চমকে দিয়েই তেলেঙ্গানা দখল করেছে কংগ্রেস। সেটা সম্ভব হয়েছে আঞ্চলিক ইসু্যকে সামনে রেখেই। তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের মুখ ছিলেন রেবন্ত রেড্ডি। রেড্ডি সম্প্রদায়ের জননেতা রেবন্ত কংগ্রেস সংস্কৃতির লোক নন। তিনি চন্দ্রবাবু নাইডুর শিস্য। তেলুগু দেশমের ছাতার তলায় অাঞ্চলিক রাজনীতি করেই তঁার উত্থান। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের জয়কে চিহ্নিত করছেন তরুণ রেবন্ত রেড্ডির জয় হিসাবেই। তেলেঙ্গানায় একবছর আগে কংগ্রেস তৃতীয় শক্তি হিসাবে বিবেচিত হচ্ছিল। কিন্তু রেবন্ত রেড্ডি প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হয়েই খেলাটা ঘুরিয়ে দেন। তেলেঙ্গানায় ভোটের লড়াইটা কোনওভাবেই মোদি বনাম রাহুল হয়ে যায়নি। লড়াইটা ছিল তেলেঙ্গানার রূপকার কেসিঅার-এর সঙ্গে তরুণ সমাজের প্রতিনিধি জননেতা রেবন্ত-র।
গোবলয়ের তিন রাজ্য– ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপি সফলভাবে মোদির মুখ তুলে ধরতে পেরেছিল। মোদির বিপ্রতীপে চলে আসে রাহুল গান্ধীর মুখ। তিন ক্ষেত্রেই লড়াইয়ে পরাস্ত হয়েছে কংগ্রেস।
মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় রাজে্যর বঞ্চনার ইসু্যতে মোদিকে আক্রমণ শুরু করেছেন। লোকসভা ভোটের আগে প্রচারের কৌশল হিসাবে এটাই সঠিক রাস্তা হতে পারে। ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে এইভাবেই রাজ্যভিত্তিক প্রচারের সুর বেঁধে দিতে হবে। সর্বভারতীয় কোনও একটি ইসু্য তৈরির রাস্তায় গেলেই ভুল হয়ে যেতে পারে। রাজ্যভিত্তিক প্রচারের কৌশলগুলিকে একটি সর্বভারতীয় রূপ দেওয়াই মূল কৌশল হওয়া উচিত। রাজে্য রাজে্য রাজনৈতিক দলগুলিকে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক ইসু্যতেই বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। যে-রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, সেখানে কংগ্রেসকেও জাতীয় দলের অহংকার ছেড়ে রাজে্যর ইসু্য নিয়ে লড়াইয়ে নামতে হবে।
দেশে কংগ্রেসের এখন মাত্র তিনজন মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেসকে মাথায় রাখতে হবে, এই তিন মুখ্যমন্ত্রীর দু’জনই অাঞ্চলিক দলের ফসল। তেলেঙ্গানার রেবন্ত রেড্ডি যেমন তেলুগু দেশম থেকে উঠে এসেছেন, তেমন কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া ছিলেন জেডিএস নেতা। রামকৃষ্ণ হেগড়ের সহযোগী হিসাবেই রাজ্য রাজনীতিতে উঠে অাসেন। রাজে্য রাজে্য নেতাদের ক্যারিশমাকে হাতিয়ার করে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাকে ভিত্তি করে রাজ্য ভিত্তিক ইসু্যতেই মোদিকে হারানো সম্ভব। মোদি-অাদানির সম্পর্ক বা জাতগণনার মতো কোনও সর্বভারতীয় অাখ্যান রচনা করে লড়াই করতে গেলেই ভুল হয়ে যাবে।