গৌতম ভট্টাচার্য: ‘‘ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করল।’’ ঠিক এতটাই সংক্ষেপে নিজের প্রতিক্রিয়া দিলেন এরাপল্লি প্রসন্ন (E. A. S. Prasanna)। দূর বেঙ্গালুরু থেকে ফোনের কণ্ঠস্বরে ফুটে বেরোচ্ছে চিড়চিড়ে জ্বালা। টাটকা বোঝা গেল, দীর্ঘ সময়ও সেই পোড়ার দাগ সারাতে পারেনি। পঞ্চাশ বছর আগের অবিস্মরণীয় ওভাল জয় নিয়ে স্টার স্পোর্টস এদিন লাঞ্চ বিরতিতে বিশেষ অনুষ্ঠান করছিল। সেই দলের অন্যতম সদস্য সুনীল গাভাসকরের (Sunil Gavaskar)উপস্থিতিতে ক্রিকেটার-অতিথিরা মুগ্ধসুরে বলছিলেন, তাঁদের পরের প্রজন্ম কী ভাবে এর পরম্পরায় প্রভাবিত হয়েছে। তার আগে অবশ্য ক্রিকেটপৃথিবী জেনে গিয়েছে ওভালের একমাত্র বিষধর সাপ যে ফের বেরিয়ে পড়েছে। অর্ধশতাব্দী পর দল নির্বাচন নিয়ে একইরকম প্রবল বিতর্ক ছাপিয়ে গিয়েছে প্রথম দিনের ক্রিকেটকে। দুঃখিত বিতর্ক নয়, ওভালে (Oval Test) অশ্বিন বাদ যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যেন ভারতীয় ড্রেসিংরুম স্পিরিটের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে ওভাল মাঠে।
মনে রাখতে হবে একাত্তর সালের পৃথিবীতে কমিউনিকেশন ব্যবস্থা এত জোরালো ছিল না। দল নির্বাচন নিয়ে তুমুল বিতর্কের কথা প্রথম জানা গিয়েছিল দেশে ফিরে প্রসন্ন মুখ খোলায়। তখন তিনি বকলমে বিশ্বের এক নম্বর অফস্পিনার। ভারতকে অতীতে বিদেশে টেস্ট জিতিয়েছেন। ট্যুর ম্যাচগুলোতে দারুণ ফর্মে। সেই তাঁকে একটাও টেস্ট না খেলিয়ে ওয়াদেকরের ভারত আগাগোড়া খেলিয়েছিল ভেঙ্কটরাঘবনকে। আর ভেঙ্কট তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকাও নিয়েছিলেন সিরিজ জয়ে। ওভাল টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের হিরো যদি চন্দ্রশেখর হন, তাহলে প্রথম ইনিংসের অবিসংবাদী বোলিং নায়ক ছিলেন ভেঙ্কট। অথচ জেতার হনিমুনেও প্রসন্নর কথাটা ব্যাপক প্রভাব তৈরি করেছিল। পতৌদি পরে সরাসরি বলেছিলেন, দল নির্বাচন বিস্ময়কর মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। ‘‘প্রসন্ন কী করে বাদ যায়?’’ এর প্রতিধ্বনি পরবর্তীকালেও উইনিং ক্যাপ্টেন ওয়াদেকরকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে।
[আরও পড়ুন: India vs England: ১৯১ রানেই শেষ বিরাটদের প্রথম ইনিংস, বোলারদের সৌজন্যে ম্যাচে ফিরল Team India]
কিন্তু ইন্টারনেটের পৃথিবীতে বিষ্যুৎবার রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বাদ যাওয়া নিয়ে যা প্রতিক্রিয়া হল, তা টেস্ট ম্যাচ হলে প্রসন্ন-অধ্যায় দেশবন্ধু পার্কের অনূর্ধ্ব তেরো টুর্নামেন্ট। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ফেটে পড়লো অশ্বিনের প্রতি সমর্থনে। টসের পরেই টুইটারে ট্রেন্ড করল। আগেকার দিনে বিরূপ লেখা হলে তারকা ভারতীয় ক্রিকেটার বলতেন কাগজটা পড়িনি। এ যুগে বলার উপায় নেই। অশ্বিনের সমর্থনে অনেকগুলো প্রতিক্রিয়ায় কোচ শাস্ত্রী (Ravi Shastri) আর ভারত অধিনায়ককে সরাসরি ট্যাগ করা হয়েছে। মোবাইল খুললেই সেগুলো কোলে এসে পড়বে। আর কী আক্রমণাত্মক সেগুলোর নির্যাস। মাইকেল ভন যেমন লিখলেন, ইংল্যান্ডের বুকে গ্রেটেস্ট নন সিলেকশন। ৪১৩ উইকেট আর ৫ সেঞ্চুরি নিয়ে কী করে কেউ বাদ যায়? এ তো পাগলামি। ক্রিকেটপ্রেমী এবং কোহলির সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ থাকা শশী থারুর পর্যন্ত টুইট করেছেন, অশ্বিন এই টিমের দু’নম্বর বোলার। তাঁকে বা শামিকে কী করে বাদ দাও? এ তো আত্মহত্যা!
বিদেশে ভারতের দল বাছা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। সৌরভের আমলেও অনিল কুম্বলেকে নিয়ে জোরদার হয়েছে। তফাৎ হল সেই সময়ের ভারত অধিনায়ক বারবার বলতেন কুম্বলের মতো বোলারকে বাদ দিয়ে তিনি কী পরিমাণ মর্মযন্ত্রণায় ভুগছেন এবং প্রথম সুযোগেই তাঁকে দলে ফিরিয়েছেন। এখানে বিরাট কোহলিকে (Virat Kohli) দেখে মনে হচ্ছে, তিনি অশ্বিনকে বাইরে রেখে যেন নিজের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চাইছেন। কী হতে পারে সেই উদ্দেশ্য? ক্রিকেট সার্কিটের দুষ্টু লোকেদের মতে সেই অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায় থেকে দু’জনের ইগোর লড়াই। যা সিনিয়র ভারতীয় ড্রেসিংরুম পর্যন্ত পৌঁছে দশ বছরের বেশি থেকে গিয়েছে। এই দুষ্টু লোকগুলোর মতে, কোহলির আপত্তিতেই অশ্বিন ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি টিমের বাইরে। কোহলির পছন্দেই রাহানে এত বছর ধরে সহ-অধিনায়ক। অশ্বিনের হওয়া উচিত–গাভাসকর একাধিকবার লিখেছেন। কিন্তু চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী কোহলি তাঁকে পাত্তাও দেননি।
[আরও পড়ুন: T-20 World Cup: ওভাল টেস্টের পরই দল ঘোষণা ভারতের, কারা সুযোগ পাবেন?]
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পর মনে করা হয়েছিল এবার অশ্বিনের প্রতি অবিচারের অবসান ঘটল। শুধু সৌরভ-ঘনিষ্ঠ দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে অশ্বিন খেলেন বলেই নয়। সৌরভ তামিল অফস্পিনারের ম্যাচ জেতানো ক্ষমতা সম্পর্কে বারবার খুব সশ্রদ্ধ। অশ্বিনকে দেখেন নবযুগের কুম্বলে হিসেবে। একইসঙ্গে ভারতীয় ড্রেসিং রুমের কাণ্ডকারখানা সবই তাঁর জানা। রিপোর্টারদের যেমন সোর্স থাকে, বোর্ড প্রধানের নাকি টিমে কিছু নির্ভরযোগ্য সোর্স আছে। বৃহস্পতিবার পরবর্তী এটা রহস্য হয়ে দেখা দিচ্ছে যে, পরপর চার টেস্টে এমন ন্যক্কারজনক কাজ চলছে দেখেও সৌরভ চুপ কেন? নাম লিখছি না। কিন্তু প্রাক্তন এক ভারত অধিনায়ক এদিন বলছিলেন, ‘‘ভেতরের ব্যাপার কিছুই জানি না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হস্তক্ষেপ করলে কেউ কিছু মনে করত না।’’ প্রসন্ন যোগ করতে চান, ‘‘অশ্বিন নিয়ে যা ঘটছে তার একমাত্র লজিক হল লজিক না থাকা।’’
টিম কম্বিনেশনের জন্য শেন ওয়ার্নকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বাদ দিয়েছিলেন স্টিভ ওয়া। ছিয়াশির বহুকথিত বেঙ্গালুরু টেস্টে আব্দুল কাদিরকে খেলাননি ইমরান। হতেই পারে তেমনি কোনও কারণ রয়েছে এখানে। গোটা বিশ্ব বুঝছে না। কিন্তু কোহলি-শাস্ত্রীর কোনও সলিড ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা আছে। প্রশ্ন হল, সেটা কী হতে পারে? গোটা সিরিজে জাদেজা (Ravindra Jadeja) দু’উইকেট পেয়েছেন। চরমতম দুঃস্বপ্নেও তিনি একাত্তরের ভেঙ্কট নন। সেই সফরের সোলকারও না যে পাঁচ নম্বরে উন্নীত হয়ে রান করে দেবেন। ব্যাটিং বেশি ভাল বলে ওকে নিয়েছি, এটাই হয়তো স্যার জাদেজাকে এদিন রাহানের আগে পাঠিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। আর সেটা স্প্যাম হয়ে গিয়েছে। অশ্বিনের পাঁচটা টেস্ট সেঞ্চুরি আছে। মাত্র কয়েকমাস আগে তিনি আর হনুমা বিহারী মিলে সিডনি মাঠে ২৫৬ বলে ৬২ রানের যে পার্টনারশিপ করেছিলেন, তা স্কোরবোর্ডকে গুলি করে ভারতীয় ক্রিকেটের লোকগাথায় ঢুকে গিয়েছে। তাহলে তিনি ব্যাটসম্যান নন কেন? তার চেয়ে বিস্ময়কর কথা অবশ্য অধিনায়ক বলেছেন টসের সময়। জাদেজা খেলছে কারণ বিপক্ষে চারজন বাঁহাতি!
[আরও পড়ুন: তালিবানি শাসনেও আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলতে পারে Team India!]
চিরকাল তো ক্রিকেটীয় যুক্তি উলটো বলে এসেছে যে, বাঁ-হাতি বেশি থাকলে অফ স্পিনার বাধ্যতামূলকভাবে খেলাও। বল বাইরের দিকে বেরোবে। বিরাট কি অশ্বিনকে বাদ দিতে এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে কোনওরকম ছুতো ছাড়বেন না? তা ন্যায্য হোক কী অন্যায্য। বাজারে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে যে, বহু বছর সাদা বলের ক্রিকেট থেকে বাদ পড়া অশ্বিনকে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভাবছেন নির্বাচকেরা। সেটা নির্মূল করতেই কি অধিনায়ক এমন সিদ্ধান্ত বারবার নিচ্ছেন যে, তুই লাল বলে চান্স পাস না, সাদা বলে কী ফিরবি? ওভাল টেস্ট জিতলে সব চাপা পড়ে যাবে এমন কথা অনেকেই বলছেন। নিশ্চিত নই। এবারে পরিস্থিতি যে জায়গায় কোথাও না কোথাও একটা ভূকম্পন হবেই। দেখছেন না পঞ্চাশ বছর আগের মামলা এখনও চলছে!