'হাসি-কান্না হিরা-পান্না'য় শেষ হচ্ছে আরও একটা বছর। বিগত হতে চলা ২০২৪ সালে শিরোনামে কখনও উঠে এসেছে বেদনাদায়ক ঘটনা কখনও বা সুখস্মৃতি। তার মধ্যেও দেশকে গর্বিত করেছেন একঝাঁক ভারতীয়। টি-২০ বিশ্বজয় থেকে শুরু করে গ্র্যামি জয়, সন্তানদের গৌরবের ছটায় আলোকিত হয়েছেন ভারতমাতা। বছর শেষে সেসব কৃতীদেরই ফিরে দেখল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
টি-২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ভারত: ২০০৭ সালে প্রথমবার টি-২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। তারপর একের পর এক কুড়ি-বিশের বিশ্বকাপে অংশ নিলেও ট্রফি অধরাই থেকে গিয়েছে মেন ইন ব্লুর কাছে। দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষা শেষে চলতি বছর টি-২০তে বিশ্বসেরা হয়েছে রোহিত শর্মার দল। গোটা টুর্নামেন্টে অপ্রতিরোধ্য ছিল মেন ইন ব্লু। পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের মতো প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল ভারত। খেতাবি লড়াইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নামে দল। টানটান ম্যাচ শেষে বিশ্বকাপ এসেছিল ভারতের ঘরে। ২০২৩ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের ক্ষতে প্রলেপ পড়েছিল। খুশির জোয়ারে ভেসেছিল গোটা দেশ।
রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত মোদি: ভারতের বন্ধু দেশগুলির তালিকায় বরাবর থাকে রাশিয়ার নাম। দুই দেশের এই সৌহার্দ্য আরও একধাপ এগিয়েছে ২০২৪ সালে। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেখানেই রাশিয়ার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দেওয়া হয় তাঁকে। রাশিয়ার অর্ডার অফ সেন্ট অ্যান্ড্রু দ্য অ্যাপোস্টল মোদিকে প্রদান করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকে রাশিয়ায় এই সম্মান দেওয়া হয়। প্রথম ভারতীয় হিসাবে ২০২৪ সালে সেই সম্মান পেয়েছেন মোদি। যদিও ২০১৯ সালে মোদিকে এই সম্মান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল রাশিয়া।
বিশ্বজয়ী গুকেশের ইতিহাস: চলতি বছর ৬৪ খোপের যুদ্ধে ইতিহাস গড়েছেন ডি গুকেশ। কনিষ্ঠতম হিসাবে দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই বিশ্বসেরার তাজ উঠল ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টারের মাথায়। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে প্রথম ১৩টি গেম অবধিও চিনা প্রতিপক্ষ ডিং লিরেনের সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর চলছিল তাঁর। কিন্তু ১৪ তম গেম জিতে নিয়ে দাবার দুনিয়াকে চমকে দেন তরুণ দাবাড়ু। গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লিরেনকে হারিয়ে ছিনিয়ে নেন বিশ্বসেরার শিরোপা। কনিষ্ঠতম হিসাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন গ্যারি কাসপারভের নজির ভেঙে। বিশ্বনাথন আনন্দের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেন গুকেশ। সেই সঙ্গে, চলতি বছরেই ইতিহাস গড়ে দাবা অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। সেই দলের সদস্যও ছিলেন চেন্নাইয়ের তরুণ দাবাড়ু গুকেশ।
মার্কিন প্রশাসনে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের জয়জয়কার: ইতিহাস গড়ে দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্টের কুরসিতে বসার আগে তিনি ভরসা রেখেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের উপরে। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে বসিয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের। তার মধ্যে অন্যতম কাশ প্যাটেল। মার্কিন তদন্তকারী সংস্থা FBI-এর শীর্ষে বসেছেন তিনি। একটা সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিবেক রামস্বামী। মাঝপথে সরে দাঁড়ান। কিন্তু মসনদে ফিরেই তাঁকে ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির অন্যতম শীর্ষপদে বসিয়েছেন ট্রাম্প। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমেরিকার সর্বেসর্বা সংস্থা NIH। গোটা দেশ কোন স্বাস্থ্যনীতি গ্রহণ করবে, সেই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি থাকে এই NIH-এর হাতে। সেই সংস্থার ডিরেক্টর পদে বসানো হয়েছে বঙ্গসন্তান জয় ভট্টাচার্যকে। দলের একাংশের আপত্তি উড়িয়ে শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হরমিত কে ধিলোঁকে বসানো হয়েছে মানবাধিকার সংস্থার শীর্ষপদে। আমেরিকার বিচার দপ্তরের অন্তর্গত সিভিল রাইটস বিভাগের প্রধান তথা অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ফর সিভিল রাইটস হয়েছেন ভারতে জন্মগ্রহণ করা হরমিত। ট্রাম্প ২.০ জমানায় বিশেষ গুরুত্ব পাবেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা, বলছে বিশেষজ্ঞ মহল।
প্যারালিম্পিকে সর্বকালের সেরা সাফল্য: ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে অন্যতম সফল বছর হিসাবে লেখা থাকবে ২০২৪। কারণ প্যারালিম্পিকে ইতিহাসে সর্বকালের সেরা পারফরম্যান্স করেছে ভারত। সবমিলিয়ে প্যারালিম্পিকে ৫০টিরও বেশি পদক জেতার নজির গড়েছেন ভারতীয় অ্যাথলিটরা। এবছর প্যারিসে আয়োজিত প্যারালিম্পিক থেকে মোট ২৯টি পদক নিয়ে ফিরছেন ভারতীয় প্যারাঅ্যাথলিটরা। মোট ৭ জন ভারতীয় অ্যাথলিট সোনা জিতেছেন। ভারতের পদক তালিকায় এসেছে ৯ রুপো এবং ১৩ ব্রোঞ্জও। প্যারালিম্পিকের সমস্ত সংস্করণ মিলিয়ে ৫০টি পদক জয়ের নজিরও গড়ে ফেলেছে ভারত। অলিম্পিকেও সাফল্য এসেছে ভারতের ঝুলিতে। জ্যাভলিন থ্রোয়ে দেশকে রুপোর পদক এনে দিয়েছেন নীরজ চোপড়া। অলিম্পিকের একই সংস্করণ থেকে জোড়া ব্রোঞ্জ পদক জিতেছিলেন শুটার মনু ভাকের। এছাড়াও শুটিংয়ে সর্বজ্যোত সিং এবং স্বপ্নিল কুসালে ব্রোঞ্জ জিতেছেন। ভারতীয় পুরুষদের হকি দল এবং কুস্তিগির আমন শেরাওয়াতও ব্রোঞ্জ পদক এনে দিয়েছেন দেশকে।
ফাইল ছবি।
মার্কিন মুলুকে উষার ইতিহাস: প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসাবে আমেরিকার সেকেন্ড লেডি হতে চলেছেন উষা ভ্যান্স। সদ্যসমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের রানিং মেট ছিলেন জেডি ভ্যান্স। তাঁরই সহধর্মিণী উষা চিলুকুরি। তাঁর পূর্বপুরুষ অন্ধ্রের গোদাবরী টাউনের টানুকুর বাসিন্দা ছিলেন। প্রায় ৫০ বছর আগে ভারত ছেড়ে তাঁরা পাকাপাকিভাবে আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। ইয়েল ল স্কুলে পড়াশোনা করতে গিয়ে জেডির সঙ্গে উষার আলাপ। ২০১৪ সালে খাঁটি ভারতীয় কায়দায় গাঁটছড়া বাঁধেন তাঁরা। বিয়ের ১০ বছর পরে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসাবে আমেরিকার সেকেন্ড লেডি হচ্ছেন উষা। মার্কিন নির্বাচনে জয়ের পর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি সাফ জানান, স্ত্রীর হিন্দুধর্মের আদর্শে ভর করেই জীবনের বহু সমস্যা সমাধান করেছেন। নিজের জীবনে এই উন্নতির কৃতিত্ব অনেকটাই স্ত্রীকে দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডেপুটি।
সুরের জগতে তিন গ্র্যামি: ৬৬তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চে দাপট দেখিয়েছেন ভারতীয় শিল্পীরা। বাঁশির সুরে বিশ্বজয় করেছেন রাকেশ চৌরাসিয়া। বেস্ট কনটেম্পোরারি ইনস্ট্রুমেন্টাল এবং বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক পারফরম্যান্স এই দুই ক্যাটাগরিতেই সেরার সেরা পুরস্কার জিতে নিয়েছেন ভারতীয় বংশীবাদক। তাঁর কোলাবরেটিভ অ্যালবাম ‘অ্যাজ উই স্পিক’ গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে মোট তিনটি স্বতন্ত্র বিভাগে মনোনীত হয়েছিল- বেস্ট কনটেম্পোরারি ইনস্ট্রুমেন্টাল, বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক এবং বেস্ট ইনস্ট্রুমেন্টাল কম্পোজিশন। এছাড়াও গ্র্যামির মঞ্চে ভারতকে গর্বিত করেছেন শংকর মহাদেবন এবং উস্তাদ জাকির হুসেন। সেরা গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি জিতে নিয়েছে তাঁদের ব্যান্ড ‘শক্তি’। 'দিস মোমেন্ট’ অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি জিতে নিয়েছে এই ভারতীয় ব্যান্ড। এই অ্যালবামে সঙ্গত করেছেন জন ম্যাকলাফিন, ভি সেলভাগণেশ এবং গণেশ রাজাগোপালনরা।
ছবি: এক্স হ্যান্ডেল
ইসরোর মুকুটে নতুন পালক: ২০২৩ সালে মহাকাশবিজ্ঞানে ইতিহাস গড়েছিল ভারত। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথমবার পা রাখে ইসরোর চন্দ্রযান-৩। সেই সাফল্যকে সম্মান জানিয়ে ইসরোকে দেওয়া হল ‘ওয়ার্ল্ড স্পেস অ্যাওয়ার্ড’। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট চাঁদের দক্ষিণ পৃষ্ঠে সফলভাবে অবতরণ করে চন্দ্রযান-৩। গোটা বিশ্ব সেদিন ভারতের ইসরোর সাফল্যের জয়গান গায়। এই বিরাট সাফল্যকে সম্মান জানিয়ে ২৩ আগস্ট দিনটিকে 'জাতীয় মহাকাশ দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে ভারত সরকার। সেই সাফল্যের এক বছর পর বিশ্ব মঞ্চে সাফল্যের স্বীকৃতি পেল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। যদিও শুধু চন্দ্রযান-৩ তেই থেমে নেই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এর পর চন্দ্রযান-৪, মঙ্গল অভিযানের পাশাপাশি ২০৪০ সালে চাঁদের মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে ভারতের গৌরব ইসরো।
অস্কারের লড়াইয়ে বাংলার ইমন: একটা সময়ে অস্কার জয়ের দৌড়ে শামিল ছিল ইন্দিরা ধর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পুতুল’ ছবির গান ‘ইতি মা’। জাতীয় পুরস্কারজয়ী বঙ্গতনয়া ইমন চক্রবর্তীর গাওয়া এই গান জায়গা করে নিয়েছিল অস্কারের বাছাই পর্বে। অস্কারের সেরা ৮৯টি গানের তালিকায় জায়গা পেয়েছিল 'ইতি মা'। গীতিকার অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং সুরকার সায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের এই গান ইতিহাস গড়ল বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। কারণ এই প্রথম কোনও বাংলা গান অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছে। অস্কারের জন্য খুব বড়মাপের ক্যাম্পেন করতে হয়। কিন্তু 'ইতি মা' সেসব ছাড়াই পৌঁছে গিয়েছিল চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ মঞ্চে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেরা ১৫টি গানের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারেনি ইমনের গান।
আইসিসিতে জয়-জমানা: দীর্ঘদিন দক্ষ হাতে সামলেছেন বিসিসিআই সচিবের দায়িত্ব। ২০২৪ সালে আইসিসির ইতিহাসে কনিষ্ঠতম হিসাবে আইসিসির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন জয় শাহ। এই পদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেননি আর কোনও বোর্ড কর্তা। সময়সীমার মধ্যে আর কোনও প্রার্থীই মনোয়ন দেননি। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। আইসিসির ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে চেয়ারম্যান হয়েছেন অমিত শাহর পুত্র। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা যেন বিশ্বজুড়ে আরও ছড়িয়ে পড়ে, সেদিকে নজর দিতে চান জয় শাহ। কুর্সিতে বসেই তাঁর সামনে ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু হাইব্রিড মডেলে খেলার জন্য ভারত-পাকিস্তানকে রাজি করিয়ে ফেলেছে জয় শাহর আইসিসি। আগামী দিনে ক্রিকেট যেন পাকাপাকিভাবে অলিম্পিকে থাকে, সে জন্যও প্রাণপণ চেষ্টা করছেন জয়।
ফাইল ছবি