সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: কথা ছিল ২০২৫ সালে বুথ স্তর থেকে ঢেলে সাজানো হবে কংগ্রেসের সংগঠন। কোন পথে সেই কাজ করা উচিত, নিচুতলার নেতৃত্বের জন্য সেই পথ বাতলে দিল কংগ্রেস হাইকমান্ড। যেখানে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হল যে, ঠান্ডা ঘরে বসে, বাবুয়ানা দেখিয়ে কংগ্রেস করা যাবে না। হয় দায়িত্ব নিতে হবে, নাহলে অবসর নিতে হবে। একইসঙ্গে বলা হল, দু’ নৌকায় পা দিয়ে চলা যাবে না। নির্বাচনী ও সাংগঠনিক-দুই ক্ষেত্রেই সামনে আনতে হবে কট্টর কংগ্রেসীদের। আহমেদাবাদের অধিবেশন থেকে সংগঠনের খোলনলচে বদলে দলকে শক্তিশালী করতে এই বার্তাগুলিই দিল কংগ্রেস হাইকমান্ড।

২০২৫ সাল কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মহাত্মা গান্ধীর দায়িত্ব নেওয়ার শততম বর্ষ। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের জন্ম সার্ধশতবর্ষ। তাই ২০২৫-কে স্মরণীয় করে রাখতে এই বছরে সংগঠন জোরদার করার বছর হিসাবে আগেই চিহ্নিত করেছে কংগ্রেস। কোন পথে তা করা সম্ভব, আমেদাবাদের ৮৬তম অধিবেশন থেকে সেই দিশা স্পষ্ট করে দিলেন খাড়গে-রাহুলরা। খাড়গে বলেন, “যারা দলের কাজ করতে ইচ্ছুক নন, তারা বিশ্রাম নিন। আর যারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে তৈরি নন, তারা অবসর নিয়ে নিন।” লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী কর্মীদের উৎসাহিত করে বলেন, “হাল ছাড়বেন না। লড়াই চালিয়ে যান। সাম্প্রদায়িক, বিভাজনমূলক মতাদর্শের বিজেপি-আরএসএসের কী হাল করি, দেখে নেবেন।” ওয়াকফ বিলকে অসাংবিধানিক হিসাবে উল্লেখ করে খ্রিস্টান, শিখ সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিলেন রাহুল। বললেন, “ইতিমধ্যেই ওদের মুখপত্রে লেখা হয়েছে এবার টার্গেট চার্চের সম্পত্তি। একে একে সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরই এভাবে আঘাত হানবে বিজেপি ও আরএসএস।”
সংগঠন শক্তিশালী করতে এই বিষয়কে হাতিয়ার করে বিভিন্ন সংখ্যালঘু মানুষের কাছে পৌঁছনোর ইঙ্গিতও দিয়ে রাখলেন রাহুল। যেটা সরাসরি বললেন না, সেই কথা মনে করিয়ে দিলেন লোকসভার উপনেতা গৌরব গগৈ। বললেন, “রাহুলজি আগেই বলেছেন যারা দু’ নৌকায় পা দিয়ে চলেন, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। যারা পুলিশের লাঠি খেয়ে, অন্যান্য অত্যাচার সহ্য করেও কংগ্রেসে আছেন, সেই কট্টর কংগ্রেসীদেরই শুধু ভোটের ময়দানে আনতে হবে।” নেতাদের বলা হল, বিধায়ক-সাংসদ হওয়ার লালসা ছেড়ে মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু হয়ে ওঠার লক্ষ্য রাখতে। নিজেদের সংগঠন শক্তিশালী করার পাশাপাশি বিজেপি-আরএসএসের জাতীয়তাবাদের ‘মুখোশ’ খুলে তাদের আসল ছবি জনসমক্ষে নিয়ে আসার কথাও উঠল অধিবেশনে। প্রদেশ, জেলা নেতৃত্বদের মন্ত্রগুপ্তি দিয়ে দেওয়া হল, যাতে তারা রাজ্যে ফিরে বিজেপি ও কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদের ফারাক সাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারেন। বলা হল, বেশি করে প্রচার করতে হবে যে, বিজেপির ‘ভুয়ো’ জাতীয়তাবাদ মানুষে মানুষে বিভেদ করায়। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদ বিবিধের মধ্যে ঐক্যের।
মোদ্দা কথা আহমেদাবাদের কর্মসমিতির বৈঠক ও অধিবেশন থেকে সংগঠনকে নতুন করে তৈরি করার ব্লু প্রিন্ট কার্যত ছকে দিল কংগ্রেস হাইকমান্ড। রাহুল যেমন মঙ্গলবারের কর্মসমিতির বৈঠকে বলেছিলেন, তফসিলি জাতি, জনজাতি ও সংখ্যালঘুদের অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়েছে অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অংশের ভোট। এবার নজর দিতে হবে সেদিকেও। কোনও ধর্ম, কোনও জাতি, কোনও গোষ্ঠীকেই বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার মঞ্চ হিসাবে তৈরি করতে হবে কংগ্রেসকে। অ্যানি বেসান্ত, সরোজিনী নাইডু, নেলি সেনগুপ্ত, ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধীদের উদাহরণ টেনে মানুষকে বোঝাতে হবে যে, বিজেপি কখনও মহিলাদের নেতৃত্বে আনতে চায় না। এটা তাদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয়। এই বার্তাও তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অধিবেশনে উপস্থিত নেতাদের। ঠিক হয়েছে, এবার থেকে প্রার্থী নির্বাচনে জেলা সভাপতিদের বক্তব্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই প্রস্তাবের পাল্টা আবার দাবি উঠল যাতে, কোনও জেলা সভাপতি ভোটের ময়দানে নামা বন্ধ করা হোক। নাহলে পক্ষপাত করে নিজেই নিজেকে মনোনীত করে দেবেন অনেকে।
সংগঠন শক্তিশালী করার পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিজেপি, আরএসএস, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি রাহুল। তাঁর কটাক্ষ, “বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস উল্টো দাবি করে চলে যায়, ৫৬ ইঞ্চির ছাতি চুপ থাকে। আমেরিকা সফরে এবার আর ট্রাম্প মোদিজিকে বুকে টেনে নেননি, মোদির বুকে ট্যারিফ গুঁজে দিয়েছেন। সবক্ষেত্রেই উনি চুপ।” নয়া মার্কিন ট্যারিফের ফলে দেশে আর্থিক ঝড় আসতে চলেছে, সেই সতর্কতাও করেছেন রাহুল। খাড়গে আবার বিজেপির হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর এই লড়াইকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসাবেও চিহ্নিত করেন। সব মিলিয়ে মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ভূমি থেকে কংগ্রেসকে নতুন রূপে প্রতিষ্ঠা করার শপথ কার্যত নিয়ে নিল হাইকমান্ড।