সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: 'প্রধানমন্ত্রী পদে আমার চেয়ে অনেক যোগ্য ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।'
'আমি মনে করি না মনমোহন অ্যাকসিডেন্টাল প্রধানমন্ত্রী। আমি নিশ্চিত ভবিষ্যতে মনমোহন সিংকে অন্যভাবে দেখা হবে।'
প্রথম বক্তব্যটি মনমোহন সিংয়ের। ২০০৪ সালে যাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। দ্বিতীয় বক্তব্যটি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। 'যোগ্যতম' হওয়া সত্ত্বেও যাঁকে ২০০৪ সালের পর থেকে কাজ করতে হয় মনমোহনের অধীনে। দুজনের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। একসময় লুটিয়েন্স দিল্লিতে প্রণব-মনমোহনের সম্পর্ক নিয়ে চায়ের কাপে তুফান উঠেছে। সরকারে কার প্রভাব বেশি সেই নিয়েও বহু আলোচনা হয়েছে দেশের রাজনৈতিক মহলে। কিন্তু একটা বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত ছিলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক যেমনই হোক, প্রণব এবং মনমোহনের ব্যবহারিক সম্পর্ক বরাবরই 'মসৃণ' ছিল। একে অপরের প্রতি সম্মানও কমেনি কখনও।
আসলে দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজের সুবাদে একে অপরের বহু উত্থান পতন দেখেছেন ভারতীয় রাজনীতির দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। মনমোহন আমলা হিসাবে কেরিয়ারের শুরুর দিকে মনমোহনের অধীনে কাজ করেন। তিনি যখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হলেন তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আবার পরে মনমোহনের মন্ত্রিসভায় কাজ করতে হয়েছে প্রণবকে। শেষদিকে আবার প্রণব রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদে মনমোহন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দুজন দুজনের 'বস'। আবার প্রতিদ্বন্দ্বীও।
২০০৪ সালে সোনিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকার করলেন তখন গোটা দেশ মোটামুটি ধরেই নিয়েছিল প্রণববাবুই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতম। প্রণববাবু নিজেও ভেবেছিলেন, তিনিই কুরসিতে বসতে চলেছেন। পরে কংগ্রেস নেতা মণিশংকর আইয়ার নিজের বইয়ে সেই সময়ের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সোনিয়া গান্ধী প্রণবের বদলে মনমোহনকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেন। তাতে কী 'ক্ষোভ' বা আক্ষেপ জমেছিল প্রণবের মনে? হয়তো জমেছিল। কিন্তু সেই ক্ষোভ বা আক্ষেপের কোনও বহিঃপ্রকাশ কোনওদিন দেখা যায়নি। বরং দুজনে একসঙ্গে মসৃণভাবে দীর্ঘদিন 'দুর্বল' জোট সরকার চালিয়েছেন। 'অরাজনৈতিক' মনমোহনের পক্ষে ১০ বছর ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা সম্ভব হত না, যদি না প্রণব মুখোপাধ্যায় নেপথ্যে থেকে সব রাজনৈতিক ঝড় সামলে দিতেন। জোট শরিকদের, এমনকী বিরোধীদের 'ম্যানেজ' করার কাজটি পুরোটাই ছিল প্রণবের দায়িত্ব। মনমোহন যখন সরকারের নীতি নির্ধারণে ব্যস্ত তখন আমলাতন্ত্র সামাল দেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক সব চাপ সামলে দিতেন প্রণব। দুজনের সম্পর্ক খুব মসৃণ না হলে আদৌ সেটা সম্ভব হত কি?
তাছাড়া দুজনের মধ্যে যে একে অপরের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও সম্মান ছিল সেটাও পরবর্তীকালে তাঁদের কথাতেই বোঝা গিয়েছে। ২০১৭–র অক্টোবরে প্রণববাবু নিজের বইপ্রকাশে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানান মনমোহনকে। সেই অনুষ্ঠানে ২০০৪ সালের জন্য প্রকাশ্যে প্রণববাবুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, 'প্রণববাবু বাই চয়েস পলিটিশিয়ান। আর আমি পলিটিশিয়ান বাই অ্যাক্সিডেন্ট। ২০০৪–এ সোনিয়াজি আমাকে প্রধানমন্ত্রী বেছেছিলেন। প্রণবজি ছিলেন আমার সবথেকে বিশিষ্ট সঙ্গী। কিন্তু সেদিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যোগ্যতম ছিলেন প্রণবই। তাই ওঁর আক্ষেপ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন, এই সিদ্ধান্তে আমার কোনও হাত নেই। তিনি আমায় শ্রদ্ধা করেন। আমাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক। আজীবন তা থাকবে।" সেদিন মঞ্চে বসে হো হো করে হেসে ফেলেছিলেন প্রণববাবু। অবশ্য মনমোহনকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিতেও কোনওদিন কুণ্ঠা করেননি প্রণববাবু। ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর 'দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স' বইয়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বলেন, "আমি মনে করি না মনমোহন অ্যাকসিডেন্টাল প্রধানমন্ত্রী। আমি নিশ্চিত ভবিষ্যতে মনমোহন সিংকে অন্যভাবে দেখা হবে। যেভাবে দেখা হয় পিভি নরসিমা রাওকে।"
আজ ভারতীয় রাজনীতির দুই মহীরুহই প্রয়াত। তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ সম্ভব হবে কিনা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে দুজনের ব্যবহারিক সম্পর্ক এবং কাজের পদ্ধতি রাজনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার বিষয় হতে পারে।