shono
Advertisement
Lawrence Bishnoi

প্রেমিকাকে হারিয়েই 'হিন্দু ডন', কীভাবে গ্যাংস্টার হয়ে উঠল লরেন্স বিষ্ণোই!

প্রেমিকা খুন না হলে অপরাধ জগতে পা রাখতেন না লরেন্স বিষ্ণোই!
Published By: Biswadip DeyPosted: 06:44 PM Nov 16, 2024Updated: 06:44 PM Nov 16, 2024

বিশ্বদীপ দে: গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়। এক দীর্ঘদেহী যুবক জিতে নিলেন আসমুদ্রহিমাচলের মন। ভারতবর্ষ চিনল 'অ্যাংরি ইয়ং ম্যান'কে। অমিতাভ বচ্চনের 'দিওয়ার' ছবির সেই বিজয় (পরবর্তী সময়ে এই ধরনের আরও চরিত্রে দেখা গিয়েছে বিগ বিকে) নিজের অপরাধ সম্পর্কে যে যুক্তিজাল বিস্তার করেছিল তা কিন্তু আজকের লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ক্ষেত্রে খাটবে না। দাউদ-পরবর্তী সময়ে যদি কোনও অপরাধী 'সেলেব' বনে গিয়ে থাকে সে অবশ্যই বিষ্ণোই। কিন্তু সে তো 'রবিনহুড' নয়। ধনী পরিবারের সন্তান। রীতিমতো কনভেন্টে পড়াশোনা করা। পরবর্তী সময়ে আইন নিয়ে পড়তে যাওয়া। কিন্তু সে কেন এভাবে গ্যাংস্টার হয়ে উঠল? এমন গল্প তো বলিউডে নেই! অনেকেই বলেন, বিষ্ণোইয়ের অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া বোধহয় সিনেমাকেও হার মানাবে।

Advertisement

১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঞ্জাবের দুতারাওয়ালি গ্রামে জন্ম হয় বলকরণ ব্রারের। হ্যাঁ, লরেন্সের আসল নাম ছিল এটাই। নিজেই নিজেকে এমন নাম দিয়েছিল সে। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ হেনরি লরেন্সের নাম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে। এই ভদ্রলোক ছিলেন লরেন্স স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। যে স্কুলে পড়াশোনা লরেন্সের। যাই হোক, ক্লাস এইটেই বাবা কিনে দিয়েছিলেন মোপেড। দামি দামি জুতো... বিলাসবহুল জীবন আগাগোড়াই। যাকে বলে সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম। গ্রামের সবচেয়ে ধনী বাড়ির সন্তান ছিল সে। বাবা ছিলেন হরিয়ানা পুলিশের কনস্টেবল। পরে চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে চাষবাসেই মন দেন। বিষ্ণোই তখন একেবারেই ছোট। কে জানত একদিন এই ছেলেই অপরাধ জগতের ডন হয়ে উঠে দাউদের উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করবে! লরেন্স নিজেও কি জানত? বলা মুশকিল।

আসলে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই তার এই দিকটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছাত্র রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়ে সে। তবে কলেজ জীবনে রাজনীতি কমবেশি সকলেই তো করে। লরেন্স বিষ্ণোইও করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে এতেই জড়িয়ে পড়ে। পড়াশোনা কার্যত শিকেয়। আর হ্যাঁ, এই সময় তার এক প্রেমিকাও ছিল! এমনটাই শোনা যায়। সেই প্রেমিকাকে নাকি জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল বিরোধী দলের কর্মীরা! এই ভয়ংকর ঘটনাই লরেন্সকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। অনেকেই বলে তার 'ভিলেন' হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই ঘটনাই ছিল অনুঘটক। প্রেমিকা হত্যার 'বদলা' নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সে। বিরোধী প্রার্থীর ম্যানেজারের গাড়িতে আগুন লাগানোর অপরাধে জেলে যেতে হয়। আর সেখানেই আলাপ রঞ্জিৎ ডোপলার সঙ্গে। সে অস্ত্র ব্যবসায়ী। এখান থেকেই 'অপরাধ' ও 'ক্ষমতা'র মাদক আরও বেশি করে লরেন্সের রক্তের গোপন অন্ধকারের ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে থাকে। ক্রমে পরিচয় গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে। বন্ধুত্ব। একে একে সম্পত নেহেরা (একেই নাকি সলমন খুনের সুপারি দেওয়া হয়েছে), বীরেন্দ্রপ্রতাপ সিং ওরফে কালা রানা, আমনদীপ মুলতানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। এরাই পরে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য হয়। মদ পাচার, অস্ত্র ব্যবসা শুরু হয়। কিন্তু এসব করার পরও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি লরেন্স। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তার সংশ্রব একই রকম ছিল এই সময়ও। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিল বিষ্ণোইয়ের বাছাই। তাকে জেতাতে উলটো দিকে দাঁড়ানো ছাত্রনেতাকেই নাকি এই সময় খুনের ছক কষে সে। আর তাতে 'সফল'ও হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পালিয়ে যায় সঙ্গীদের সঙ্গে। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হয় লরেন্স বিষ্ণোই। সেই থেকে গুজরাটের সবরমতী জেলে রয়েছে বিষ্ণোই।

এখানেই সব শেষ হওয়ার কথা। ধনীর বখাটে ছেলের হাজতবাস। এবং যাবতীয় হিরোগিরির সমাপ্তি। কিন্তু হল উলটোটা। গ্যাংস্টার হিসেবে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের আসল যাত্রা এই সময়ই শুরু হতে থাকে। গত দশ বছরে ক্রমেই বেড়েছে তার রাজ্যপাট। যা পাঞ্জাব থেকে ক্রমেই বেড়ে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে।

ছবি: প্রতীকী

সম্প্রতি শোনা গিয়েছে, ‘লরেন্স- আ গ্যাংস্টার’ স্টোরি নামে একটি ওয়েব সিরিজ তৈরি হবে। এই সিরিজে লরেন্সের যাবতীয় কুকীর্তি তুলে ধরা হবে। কিন্তু কী করে এমন রাজপাট গড়ে তুলল সে? তাও জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বসে? যা নানা কূটপ্রশ্নও তুলে দিচ্ছে। ভাবতে বসলে ফেলুদার মতোই বলতে হয়, ''নিশ্চিন্ত আর থাকা গেল না রে তোপসে!'' তার আগে একবার সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক লরেন্সের 'হিট' অপরাধের তালিকা।

সবচেয়ে আগে অবশ্যই রয়েছে সলমন খানকে হত্যার হুমকি। এই হুমকিই গোটা দেশে সকলের কাছেই বোধহয় লরেন্সের নামটা পৌঁছে দিয়েছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও কুখ্যাত কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত বিষ্ণোই। কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার অভিযুক্ত হিসেবেই বিষ্ণোই গ্যাংয়ের নিশানায় সলমন খান। একাধিকবার বলিউডের ভাইজানকে খুনের হুমকি দিয়ে খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে কুখ্যাত গ্যাংস্টার। ২০২২ সালে পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালা খুনেও জড়িয়েছে তার নাম। ২০২৩ সালে খলিস্তানি জঙ্গি সুখদুল সিং গিল, গ্যাংস্টার সুখদেব সিং গোগামেডির খুন। তালিকা অনেকটা লম্বা। যার সাম্প্রতিক সংযোজন বাবা সিদ্দিকি। এনসিপি নেতার মৃত্যুর পর নতুন করে সলমনকে খুনের হুমকির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসছে। কেননা তিনি বাবা সিদ্দিকির ঘনিষ্ঠ। তাছাড়া সম্প্রতি সলমনের বাড়ির বাইরেও গুলি চলেছিল।

সব মিলিয়ে দেশজুড়ে সেলেব্রিটি অপরাধীর তকমা পাচ্ছে লরেন্স বিষ্ণোই। জেলে বসেই যে নাকি চালাচ্ছে সাতশো শার্প শুটারের গ্যাং! এবং তাও 'সস্তা'য়। বাবা সিদ্দিকির জন্য দেওয়া সুপারির অঙ্ক নাকি মাত্র ৫০ হাজার! আর একটা বিষয় হল গোপনীয়তা। এই সব শুটারকে যে 'হুকুম' দিচ্ছে তাকে ছাড়া গ্যাংয়ের আর কাউকেই সে চেনে না। এমনকী, যদি একসঙ্গে তিনজনকে সুপারি দেওয়া হয়, সেখানেও নাকি একে অপরকে না চিনেই অ্যাকশনে যোগ দেয় শুটাররা! অর্থাৎ এদের মধ্যে একজন ধরা পড়লে সে পুলিশকে কিছুই বলতে পারবে না। কেননা সে বিষ্ণোই গ্যাং সম্পর্কে কিছুই জানে না।

এমনও বলা হচ্ছে, খলিস্তানিদের নাকি প্রবল ঘৃণা করে লরেন্স। কিন্তু খলিস্তানপন্থী গোষ্ঠী বব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনতেও বাঁধেনি তার। কাজেই সে খলিস্তানিদের ত্রাস, একথাও খাটে না। কোনও বড় আদর্শও তার সামনে নেই। অথচ হাতে হনুমানের ট্যাটু করিয়ে নিজের 'হিন্দু' পরিচয়কে আলাদা করে সামনে রাখতে চেয়েছে সে। দাউদ পরবর্তী সময়ে ভারতের বুকে এক 'হিন্দু ডন' হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে শুরু করেছে 'বুদ্ধিমান' লরেন্স বিষ্ণোই।

এমনই তার কুখ্যাতি, যে সেই অন্ধকারের রেশ পৌঁছেছে আমেরিকা-কানাডায়। বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সঙ্গে নাকি হাত মিলিয়েছে ভারত! হরদীপ সিং নিজ্জর খুন নিয়ে এমনই বিস্ফোরক দাবি করা হয়েছে কানাডা পুলিশের তরফে। তাদের দাবি, ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগ রয়েছে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের। কিন্তু ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের তরফ থেকে জানানো হয়, লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের একাধিক সদস্যকে ভারতে প্রত্যপর্ণের জন্য কানাডার কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেই কথায় কান দেয়নি অটোয়া। উলটে নিজ্জর খুনে জড়িত গ্যাংস্টারদের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। সব মিলিয়ে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নাম আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। অথচ আদপে সে রয়েছে গরাদের ওপারে! শোনা যায়, বেআইনি ভাবে জোগাড় করা সিম থেকে আরও নানা কারচুপি করে 'ডাব্বা কলিং' করেই সে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। আর এভাবেই জেলে বসে সর্বত্র ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে দিয়েছে লরেন্স বিষ্ণোই। যদি বলিউডকেই ধরা যায়, তাহলে গ্যাংস্টার ছবিগুলোর শেষে 'লোভে পাপ পাপে মৃত্যু'ই প্রতিষ্ঠিত হয় বার বার। লরেন্সের পরিণতি কী শেষপর্যন্ত কী হয় তা দেখতেই মুখিয়ে রয়েছে সকলে। কেননা এমন গ্যাংস্টারের জীবন যে চিত্রনাট্যের চেয়েও বিপুল সাসপেন্সের! ফলে এর পরবর্তী অধ্যায় কী হতে পারে তা নিয়ে চর্চার গতি ক্রমেই বাড়ছে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • দাউদ-পরবর্তী সময়ে যদি কোনও অপরাধী 'সেলেব' বনে গিয়ে থাকে সে অবশ্যই লরেন্স বিষ্ণোই।
  • কিন্তু সে তো 'রবিনহুড' নয়। ধনী পরিবারের সন্তান। রীতিমতো কনভেন্টে পড়াশোনা করা। পরবর্তী সময়ে আইন নিয়ে পড়তে যাওয়া।
  • অনেকেই বলেন, বিষ্ণোইয়ের অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া বোধহয় সিনেমাকেও হার মানাবে।
Advertisement