সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: এবার আর নরেন্দ্র মোদি নয়। বরং মর্যাদা পুরুষোত্তম রামকে সামনে রেখেই ঝাঁপাতে হবে নির্বাচনী বৈতরণীতে। বিজেপিকে এই বার্তাই দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) (আরএসএস)। যতই ‘মোদি ম্যাজিকে’র কথা বলে নিজেদের ঢাক পেটান বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা, আদতে দলের রিমোট কন্ট্রোল পুরোপুরি রয়েছে নাগপুরের ড.হেডগেওয়াড় ভবনে। সেখান থেকেই সংঘ পরিবারের প্রধান মোহন ভাগবতের এই নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছে দিল্লির ৬ এ, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের পাঁচতারা বিজেপি (BJP) সদর দফতরে। যেখানে বলা হয়েছে, ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে যেভাবে দেশজুড়ে এক ‘অন্য’ বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে, নির্বাচন পর্যন্ত তা বয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য গোটা জানুয়ারি ও তারপর আরও একমাস ধরে ছোট-বড় বিভিন্ন কর্মসূচিও নেওয়া হচ্ছে।
এ তো না হয় গেল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। কিন্তু সম্প্রতি বিজেপির কয়েকটি সিদ্ধান্তের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কীভাবে তাদের রাশ আরও কড়া হাতে সামলাচ্ছে আরএসএস। বুধবার নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দপ্তরে গিয়ে যে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ বিষয় খোলসা হল, তার মধ্যে অন্যতম খালি চোখে দেখে যতটা মনে হচ্ছে, নাড্ডা তো দূর, মোদি বা শাহের হাতেও নেই বিজেপির নিয়ন্ত্রণ। কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর নিজেদের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর এক সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, আঞ্চলিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাতেই হয়েছে ভরাডুবি। নিচুতলায় আর ততটা কাজ করছে না মোদি ম্যাজিক।
অটল জমানায় ঠিক যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বাজপেয়ী-আডবানীদের, সেই বার্তাই মাসখানেক আগে আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে মোদি-শাহদের। সেবারও বিজেপির ‘সানশাইন’-এর দাবিকে মান্যতা দেয়নি সাধারণ মানুষ। এবারও একইভাবে দিচ্ছে না ‘অমৃতকাল’-কে। তাই আরও বাস্তবসম্মত হয়ে আঞ্চলিক থেকে শুরু করে সর্বভারতীয়–সব ক্ষেত্রে নতুন মুখ নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। মনে করা হচ্ছে, সেই নির্দেশ মেনেই সম্প্রতি রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে তিন নতুন মুখকে বসানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর হটসিটে। এবার দেখার শুধু লোকসভা নির্বাচনে ব্র্যান্ড মোদিকে পিছনে ফেলে কতটা জায়গা দেওয়া হয় ‘রামলালা’-কে।
[আরও পড়ুন: আর্থিক প্রতারণা মামলায় ইডির চার্জশিটে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নাম! লোকসভার আগে মাথায় হাত কংগ্রেসের]
কী হতে চলেছে আসন্ন নির্বাচনে আরএসএস-এর রণনীতি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এদিন ‘মহল’ থেকে আরও একবার সামনে এল সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া শব্দবন্ধ। ‘আমরা তো আধ্যাত্মিক পথে সমাজসেবা করে থাকি। এগুলো রাজনীতির বিষয়।’ তবে তার মাঝেই ভবনের কয়েকজন ‘প্রমুখ’-এর সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, তাতে মোদি-শাহের জমানায় বিজেপির লাগাম প্রায় পুরোটাই নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে আরএসএস। পর্দার আড়ালে সুতোয় টান দিয়ে বিজেপিকে পরিচালনা করছেন মোহন ভাগবত নামক জনৈক নেতাই। সাম্প্রতিক সময়ে কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বের পথে চলার ঘটনাও ভালভাবেই উঠে এসেছে তাঁর নোটবুকে।
তাই ইতিমধ্যেই তিনি বার্তা দিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বকে পিষে ফেলতে ব্যবহার করতে হবে রাম ও রামমন্দিরের আবেগকে। ক্রমাগত এই বিষয় সামনে এনে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে হবে কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বকে। নইলে বিপদ অপেক্ষা করছে বিজেপির জন্য। তাছাড়া নিজেদের গায়ে লেগে থাকা হিন্দুত্বের জার্সির রংকে কিছুটা ফিকে করে অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টাও চালাচ্ছে আরএসএস। যে কারণে মণিপুর দাঙ্গার পর মৃদু কণ্ঠে হলেও সেই ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছে ভাগবতকে। উল্টে সাম্প্রদায়িক উস্কানির দায় মিডিয়ার উপর চাপানোর চেষ্টাও চলেছে পুরোদমে। এই ধরনের নানা ‘পরিবর্তন’ এনে মোদির হ্যাটট্রিকের পথ সুগম করতে চাইছে নাগপুরের আরএসএস সদর দপ্তর। দেখার শুধু তাদের এই ভোলবদল কীভাবে নেয় দেশের বিচক্ষণ জনতা।