shono
Advertisement

বুক ঢাকলেই দিতে হত কর! প্রতিবাদে কেটেছিলেন নিজের স্তন, ইতিহাসে মলিন এই ভারতীয় রমণী

এই প্রতিবাদ কেন অবহেলিত আমাদের ইতিহাসে?
Posted: 05:04 PM Nov 25, 2022Updated: 05:21 PM Nov 25, 2022

বিশ্বদীপ দে: ‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’ কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় এমনই স্বপ্ন দেখেছিলেন। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে যুগে যুগে এভাবেই সরব হতে দেখা গিয়েছে কল্যাণকামী মানুষদের। কিন্তু কাজটা যে সহজ নয়, ইতিহাস তার সাক্ষী। প্রাচীন যুগের শাসকের চোখে অলঙ্কার, অর্থ, জমির মতো নারীও ছিল রাজভোগ্য। যার হাতে ক্ষমতা সেই অধিকার পাবে নারীর। এছাড়াও নানা ভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে নারীদের। আর একথা বলতে বসলে এসে পড়বেই সেকালের ত্রিবাঙ্কুর (Travancore) রাজ্যে স্তন করের কথা।

Advertisement

ব্রাহ্মণরা ছাড়া স্তন (Breast) ঢেকে রাখার অনুমতি ছিল না কারও। ঢাকলেই দিতে হত কর। এই ঘৃণ্য আইন শেষ পর্যন্ত যে নারীর জন্য রদ করা হয়েছিল তিনি নাঙ্গেলি। এই দলিত রমণীর নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। নিজের প্রাণ দিয়ে তিনি যেভাবে নারীর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা যেমন করুণ তেমনই গর্বের ইতিহাস।

ত্রিবাঙ্কুরের রাজ দরবার

[আরও পড়ুন: ‘ব্রহ্মাস্ত্র’কে টেক্কা! মাত্র ৭ দিনেই ১০০ কোটি পেরিয়ে গেল ‘দৃশ্যম ২’র ব্যবসা]

তবে সেকথা বলার আগে বলার দরকার কেমন ছিল সেযুগের ত্রিবাঙ্কুরের রাজশক্তি? কর বসানোয় তাদের জুড়ি মেলা ছিল ভার। মৎস্যজীবীদের জাল রাখার জন্য কর দিতে হত। আবার গোঁফ রাখার জন্যও ছিল করের নিদান। অলঙ্কার পরতে গেলেও দিতে হত কর। সব মিলিয়ে ১১০ রকমের কর। দরিদ্র প্রান্তিককে শোষণের ‘অভাবনীয়’ দৃষ্টান্ত। যার মধ্যে অন্যতম তালাক্করম। বাংলা করলে দাঁড়ায় মাথার জন্য কর। আর ছিল মুলাক্করম। অর্থাৎ স্তন কর। আগেই বলা হয়েছে, সেটা কী ব্যাপার। বুক ঢাকতে পারবেন না কোনও অব্রাহ্মণ নারী। এই করেরও রকমফের ছিল। স্তনের আকার অনুযায়ী ঠিক হত করের অঙ্ক। যাঁদের স্তনের আকার ছোট, তাঁদের থেকে বেশি কর দিতে হত গুরুস্তনীদের। কৈশোরের সূচনায় স্তনুদ্গমের সময় থেকেই লাগু হত এই কর।

বলাই বাহুল্য, এ ছিল শোষণের এক নগ্ন প্রকাশ। সমাজের প্রান্তিক মানুষদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে দমনপীড়ন। এভাবেই চলছিল। তারপর একদিন একজন রুখে দাঁড়াতেই… ইতিহাস বারবার এমন মুহূর্ত দেখেছে। স্তন করের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রতিবাদের সেই মুখের নাম নাঙ্গেলি। ইজাভা সম্প্রদায়ের দলিত এক রমণী।

নাঙ্গেলিকে নিয়ে হয়েছে চলচ্চিত্রও

[আরও পড়ুন: সৌদি যুবরাজকে ভিসায় ছাড়পত্র দেওয়ার প্রসঙ্গে মোদির উদাহরণ কেন, আমেরিকার প্রতি রুষ্ট ভারত]

নাঙ্গেলি ও তাঁর স্বামী চিরুকানন্দন বাস করতেন রাজ্যের উপকূলবর্তী এক ছোট্ট গ্রামে। সেই গ্রামের নাম চেরথালা। ক্ষেতমজুর হিসেবে কাজ করতেন তাঁরা। কোনওমতে গ্রাসাচ্ছেদন করে হত দিন গুজরান। এই পরিস্থিতিতে একদিন আচমকাই জ্বলে উঠলেন নাঙ্গেলি। যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিলেন দীর্ঘ শোষণ ও বঞ্চনার মোকাবিলা করতে।

ঠিক কী ঘটেছিল সেই দিন? স্থানীয় এক সরকারি কর্মী পর্বরতিয়ার দলিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কর সংগ্রহ করতেন। স্তন করের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। নাঙ্গেলিও মনে মনে ফুঁসছিলেন রাগে। কর দিতে দিতে জেরবার হয়ে যেতে হচ্ছিল। একেই উপার্জন নামমাত্র। তার উপর করের অত্যাচার। এহেন পরিস্থিতিতে দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করতেই নাভিশ্বাসের জোগাড় হতে হচ্ছিল। তাই একদিন আগ্নেয়গিরির লাভা উদগীরণের মতোই নাঙ্গেলির মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠাটা বোধহয় স্রেফ সময়েরই অপেক্ষা ছিল।

ভারতবর্ষের মানচিত্রে সেকালের ত্রিবাঙ্কুর

ঘটনার দিন পর্বরতিয়ার তাঁদের বাড়ি আসতেই নাঙ্গেলি স্থির করলেন, আজ তিনি মুলাক্করম দেবেন না। পর্বরতিয়ার ও তাঁর সঙ্গীদের দরজাতেই অপেক্ষা করতে বলে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। তারপর হাতের ধারালো অস্ত্র তুলে নিয়ে দুই কোপে নিজের দু’টি স্তন কেটে ফেললেন! আর তা কলাপাতায় মুড়ে তুলে দিলেন কর সংগ্রাহকদের হাতে। শরীরময় তখন যন্ত্রণার ভয়াবহ ছোবল। পর্বরতিয়াররা বুঝতে পারেননি প্রথমে। সাধারণত চালই দেওয়া হত কর হিসেবে। তাঁদের ধারণা ছিল, কলাপাতায় মুড়ে চালই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে যান। ক্রমে ভয়ে কার্যত সাদা হয়ে যায় তাঁদের মুখ। বেগতিক বুঝে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়েই যান তাঁরা সকলে। বাড়ির দরজায় লুটিয়ে পড়ে যান রক্তাক্ত নাঙ্গেলি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মারা যেতে পারেন। তবে শারীরিক কষ্ট যতই থাক, মানসিক একটা শান্তিও ছিল তাঁর। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁর এই আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না।

খবর সত্য়িই ছড়িয়ে গেল দাবানলের বেগে। প্রতিবেশীরা জড়ো হচ্ছিলেন নাঙ্গেলির অচেতন দেহের পাশে। কেউ একজন দ্রুত খবর দিলেন চিরুকানন্দনকে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে হাজির হলেন তিনি। যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখানেই শেষ নয়। এরপর নাঙ্গেলির দেহ দাহ করার সময় চিতায় লাফিয়ে পড়ে নিজের প্রাণ দিলেন চিরুকানন্দনও। তিনি বোধহয় এদেশের প্রথম পুরুষ যিনি ‘সতী’ হন। অর্থাৎ স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণের পথ বেছে নেন।

শিল্পীর কল্পনায় নাঙ্গেলি

নাঙ্গেলির অনুমান ভুল ছিল না। দ্রুতই রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে যায় আতঙ্কপ্রবাহ। পাশাপাশি জ্বলতে শুরু করে বিদ্রোহের আগুনও। এতদিনের অবদমিত কণ্ঠগুলি যেন কী এক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠল। আর একথা তো জানাই, সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ জাগ্রত হলে রাষ্ট্রশক্তি ভীত হয়। এক্ষেত্রেও তাই হল। তৎকালীন রাজা বাধ্য হলেন স্তন কর প্রথা তুলে নিতে। একজনের প্রাণের বিনিময়ে এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেলেন অসহায় দলিত মানুষরা।

কিন্তু নাঙ্গেলির প্রতিবাদ তবুও যেন অবহেলিতই রয়েছে আমাদের ইতিহাসে। দেশের বাকি অংশের মতোই চেরথালা গ্রামই ভুলে গিয়েছে মহীয়সী সেই নারীকে। কোনও স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি তাঁর স্মৃতিতে। তবে সি কেশবন বা কে আর গৌরীর মতো স্থানীয় নেতারা অবশ্য আজও নাঙ্গেলির সেই ইতিহাসকে তুলে ধরেন সকলের সামনে। এবং লীনা, যিনি নাঙ্গেলির উত্তরাধিকারী তিনিও গর্বের সঙ্গে নিজের পূর্বসূরীর সেই অসমসাহসী সেই প্রতিবাদের কথা বলেন গর্বের সঙ্গে। নতুন প্রজন্ম সেই কাহিনি থেকে গর্ব অনুভব করেন। তাই ইতিহাসে অবহেলিত হয়েও লোকশ্রুতিতে নাঙ্গেলি রয়ে গিয়েছেন উজ্জ্বল হয়ে। আজও অসহায় নারীদের লড়াইয়ের পথে তিনি এক অদম্য অনুপ্রেরণা। নাঙ্গেলি থেকে যাবেন। তাঁকে মোছা যাবে না জনমানসের হৃদয় থেকে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement