দুলাল দে: আইএসএলে ভারতীয় ফুটবলারদের মান এখনও পর্যন্ত সেই উচ্চতায় পৌঁছয়নি বলে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ভাল হচ্ছে না। এমনই মনে করছেন, ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ (Igor Stimac)। এমনকী আইএসএলের (ISL) ভারতীয় ফুটবলাররা যোগ্যতার তুলনায় বেশি অর্থ পাচ্ছেন বলেও মনে করছেন জাতীয় কোচ। আর তাতেই ফুটবলাররা আরামপ্রিয় হয়ে পড়ছেন। যার প্রভাব জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময় পড়ছে বলে মনে করছেন ইগর স্টিমাচ।
এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ম্যাচ খেলার জন্য এই মুহূর্তে কলকাতায় রয়েছে ভারতীয় দল। এদিন সকালে রাজারহাটের টিম হোটেলে বসে ভারতীয় ফুটবল নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে করতে এরকমই মন্তব্য করে বসেন একদা লুকা মদ্রিচের কোচ।
[আরও পড়ুন: হাতাহাতি, ইট ছোঁড়াছুঁড়ি! কেকে’র শেষ কনসার্টে ঢুকতে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, দাবি প্রত্যক্ষদর্শীর]
এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের প্রস্তুতি ম্যাচে জর্ডনের বিরুদ্ধে হারতে হয়েছে ০-২ গোলে। এক্ষেত্রে জাতীয় কোচের ব্যাখ্যা হল, “শারীরিক দক্ষতায় পিছিয়ে থাকার জন্যই অনেক সময় শেষ মুহূর্তের গোলে আমাদের হারতে হয়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে, ভারতীয় দলের পরপর জেতার মানসিকতার অভাব। কারণ, এশিয়ার প্রথম সারির দলগুলির ফুটবলারদের চেহারা আমাদের থেকে অনেকটাই শক্তিশালী।”
কিন্তু যে মনবীর, লিস্টন কোলাসোরা ক্লাবের হয়ে আইএসএলে দারুণ খেলছেন, তাঁদেরই জাতীয় দলে নিষ্প্রভ লাগে। কোনও রাখঢাক না রেখে ইগর বললেন, “ক্লাবের হয়ে আইএসএলে খেলা, আর জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা এক নয়। ভারতীয় ফুটবলাররা যে মুহূর্তে আইএসএলে খেলছে, কোনও বল এলে ধীরে সুস্থে, দেখেশুনে বলটা রিসিভ করতে পারছে। কিন্তু যে মুহূর্তে জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামছে, পরিস্থিতিটাই বদলে যাচ্ছে। বল রিসিভ করতে গেলেই ঘাড়ের কাছে প্রতিপক্ষ ফুটবলাররা চলে আসে। দেখে খেলার কোনও সুযোগই নেই। অথচ আইএসএলে অন্যভাবে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক ম্যাচ। অনেকটা সময় পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক ম্যাচে সেসব সুযোগ কোথায়? আর তাই যাদের আইএসএলে ভাল লাগে, তাদের জাতীয় দলে অন্যরকম মনে হয়।”
আর এই প্রসঙ্গেই চলে আসে আইএসএলে ভারতীয় ফুটবলারদের বিশাল বেতন পাওয়ার প্রসঙ্গ। স্টিমাচ বলেন, “ফুটবলারদের ভাল বেতন পাওয়ার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আইএসএলের ভারতীয় ফুটবলাররা যা বেতন পায়, ইউরোপের অনেক দেশের ফুটবলাররাই তা পায় না। বিশাল বেতন, পাঁচতারার আরামদায়ক জীবন পেয়ে হয়তো ফুটবলাররা সন্তুষ্ট হয়ে পড়ছে। আইএসএল খেলার জন্য ফুটবলাররা প্রচুর বেতন পায়। কিন্তু জাতীয় দলে খেলার জন্য শুধুই জার্সির সম্মান।”
কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? স্টিমাচ বললেন, “আমি তো অ্যাকাডেমির কোচ নই যে, ফুটবলারদের নিয়ে ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম করব। হাতে যা পাচ্ছি, সেভাবেই আমাকে পরিকল্পনা করতে হয়। আইএসএলের কোনও ক্লাবে ভারতীয় স্ট্রাইকার নেই, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার নেই। তাহলে সুনীল ছাড়া আমি জাতীয় দলে স্ট্রাইকার পাব কোথায়? আমি তো আর জাতীয় দলে স্ট্রাইকার তৈরি করতে পারব না। একটা কথা মেনে নেওয়াই ভাল, আইএসএলে যে বিদেশি ফুটবলাররা খেলতে আসছে, তারা অন্য কোথাও সেভাবে জায়গা না পেয়ে বেশি বেতনের জন্যই আসছে। ফলে সেখান থেকে ভারতীয় ফুটবল কতটা উপকৃত হবে জানি না।”
আইএসএলের কোচদের সঙ্গে আপনি কি কখনও আলোচনা করে ভারতীয় ফুটবলারদের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছিলেন? স্টিমাচ বলেন, “ভারতীয় ফুটবলারদের সুযোগ দেওয়া উচিত, আইএসএলের কোচদের এরকম বলার জায়গায় আমি নেই। আমি বাস্তবটা বোঝানোর চেষ্টা করছি মাত্র। সেই জন্যই বলেছি, অন্তত আই লিগটাকে বিদেশিমুক্ত করা হোক। সেখানে প্রতিটি পজিশনে ভারতীয় ফুটবলারদের খেলা উচিত।”
কোয়ালিফাইং রাউন্ড টপকে এশিয়ান কাপের মূলপর্বে যেতে না পারলে, জাতীয় কোচের পদ থেকে যে বিদায় আসন্ন, তা বুঝে গিয়েছেন স্টিমাচ। তবুও বলছিলেন, “এশিয়ান কাপ নিয়ে আমি কোনও চাপে নেই। কারণ, ভারতের দায়িত্ব নেওয়ার সময়েই জানতাম, এখানে কোচিং করানো আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। এখানে জাতীয় কোচের কাছে যে পরিমাণ প্রত্যাশা করা হয়, তারসঙ্গে বাস্তবের অনেকটা পার্থক্য থাকে। যখন জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, এত কোটির দেশ, সেখান থেকে ১১জন ভাল ফুটবলার পাওয়া কোনও সমস্যাই হবে না। কিন্তু এসে দেখলাম, সর্বোচ্চ পর্যায়ে মাত্র ১০টি ক্লাব। আর সেরা ফুটবলার মাত্র ৫০জন। যার মধ্যে ১০জন গোলকিপার।’’
আই লিগ জয়ী গোকুলামের থেকে কোনও ফুটবলার কেন জাতীয় লিগে নেই? স্টিমাচের ব্যাখ্যা হল, “আইলিগ জেতার জন্য গোকুলামকে আমার শুভেচ্ছা। কিন্তু বাস্তবটা স্বীকার করতেই হবে। আই লিগের ফুটবলাররা জাতীয় দলের মানের নয়। যদিও আই লিগের সব কোচই দাবি করবেন, তাঁর দলের অন্তত তিনজন করে জাতীয় দলে খেলা উচিত। জাতীয় দলের আমার চাই সন্দেশের মতো শক্তিশালী মাসলের ফুটবলাররা। যাঁরা অান্তর্জাতিক ফুটবলে একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে লড়াইটা করেত পারবে।”
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পর সেই রাতেই লুকা মদ্রিচের সঙ্গে কথা হয় স্টিমাচের। কি বললেন মদ্রিচ? স্টিমাচ বললেন, “তখন ও ক্লাউড নাইনে ছিল। বলছিল, সারা বছর প্রচুর ম্যাচ খেলেছে। বিশ্বকাপের আগেও নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য সেভাবে সময় পাবে না।”