রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: গৌতম গম্ভীর কেকেআরের দিকে তাকালেনই না। মাঠে ট্রেনিং চলাকালীন নয়, পশলা বৃষ্টিতে ট্রেনিং ফেলে ইডেনের ‘ভিজিটার্স ড্রেসিংরুমে’-র দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় নয়। সোনালি-বেগুনির উপস্থিতি অদৃশ্য যেন, মাঠে থেকেও যাঁরা ওই খর্বকায় বিশ্বজয়ী বাঁ হাতির কাছে অস্তিত্বহীন। ইডেনে দুই টিমের ‘সীমান্ত’ টপকে সুনীল নারিন লখনউ সুপার জায়ান্টস (Lucknow Super Giants) ভূখণ্ডে ঢুকে পড়লেন একবার। বর্তমান এলএসজি বোলিং কোচ মর্নি মর্কেল (যিনি এককালে খেলেছেন কেকেআরে নারিনের সঙ্গে) গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু তিনি গম্ভীর–ঈষৎও নড়লেন কী? নাহ্, যেমন ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন, আছেন তেমনই তো। আসলে গম্ভীরের হৃদয়ে কেকেআর আর আবেগের দুলুনি দেয় না। গৌতম গম্ভীর তাই আর কেকেআরের দিকে তাকানও না!
মানুষের মন বড় বিষম বস্তু। জটিলও বটে। দুঃখ-যন্ত্রণা-আঘাত পেলে বলা হয়, সময়ই তার নিরাময়ের শ্রেষ্ঠ ওষুধ। বলা হয়, তবে তা চিরসত্য নয়। নইলে কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যাওয়ার সময় কেন আজও অতিকায় কেকেআর হোর্ডিংয়ে নিজেকে এখনও খোঁজেন গম্ভীর (Gautam Gambhir)? কেন হোটেল বদলে যাওয়ায় মনটা আচম্বিতে খারাপ হয়ে যায় এখনও? শোনা যায়, কেকেআরে (KKR) থাকার সময় যে হোটেলে থাকতেন গম্ভীর, তার পরিবেশ, তার লোকজনের সঙ্গে একটা অদ্ভুত হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। সময় পেলে দার্জিলিং লাউঞ্জে গিয়ে বসে থাকতেন চুপচাপ। অবসরে হোটেল অন্তর্গত সুইমিং পুলে গিয়ে মাছদের খাওয়াতেন। মশলা ধোসা, কলকাতার গুলাবজামুন বড় প্রিয় ছিল গম্ভীরের। সেই হোটেলের নাকি এক ‘শেফ’ ছিলেন শোনা যায়, যাঁকে প্রাক্তন নাইট নেতার এ সমস্ত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে কিছু বলতেও হত না। ঠিক নিয়ে তিনি হাজির হয়ে যেতেন। রাত-বিরেতে শিশু সন্তানের খাবারের বন্দোবস্ত করতেও দু’বার ভাবতে হত না। দিন বদলেছে। সময় বদলেছে। গম্ভীরের টিম বদলের সঙ্গে বদলেছে তাঁর পুরনো আস্তানাও। বাইপাসের ধারের সেই হোটেল এবার ঠিকানা নয় লখনউ সুপার জায়ান্টস মেন্টরের। আলিপুরের অভিজাত হোটেলে নতুন টিম আছে, থাকতে হচ্ছে তাঁকেও। নতুন হোটেলে আছে সমস্ত, কিন্তু প্রাণ?
[আরও পড়ুন: ফের কর্ণাটকের কুরসিতে সিদ্দারামাইয়া, ডেপুটি শিবকুমার, বেঙ্গালুরুর স্টেডিয়ামে নিলেন শপথ]
গম্ভীর কলকাতায় দলবল নিয়ে খেলতে এলে, এ সব নিয়ে নিরন্তর চর্চা-আলোচনা হওয়া অতীব স্বাভাবিক। এবং হচ্ছেও। কলকাতাকে, কলকাতার টিমকে কম কিছু দেননি দিল্লিওয়ালা। কেকেআরকে দু’বার আইপিএল (IPL 2023) চ্যাম্পিয়ন করেছেন। শহরের প্রতি তাঁর হৃদয়ের টান এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, গম্ভীর ভেবেও ফেলেছিলেন বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাট কিনবেন। টিম হোটেলের ঠিক পাশে। দিল্লি থেকে শিফট করে পাকাপাকি চলে আসবেন। হায়, মানুষ ভাবে এক, বাস্তবে হয় আর এক। কেকেআর নিয়ে, কেকেআরের শহর নিয়ে গম্ভীর ভেবে ফেলেছিলেন অনেক কিছু। কিন্তু কেকেআর বা তার শহর ভাবেনি। বছর কয়েক আগে আইপিএলে দিল্লি জার্সিতে ইডেনে আউট হওয়ার মুহূর্তটা তো মনে থাকা উচিত প্রাক্তন নাইট অধিনায়কের। মনে থাকা উচিত, তাঁর ক্লান্ত, অবসন্ন অবয়বের ব্যাকড্রপে চলতে থাকা সে দিনের ইডেন জনতার নারকীয় উল্লাস।
তা, শনিবাসরীয় ইডেনে গম্ভীর শহরের গরিষ্ঠ অংশকেই খুব সম্ভবত নিজের দিকে পাবেন। সবুজ-মেরুন জার্সিতে লখনউ সুপার জায়ান্টস জার্সিতে শনিবারের ইডেনে মাঠে নামানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছেন লখনউ কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, তার পর নাইটদের যে পালটা আবেগের ব্যারিকেডের সামনে আজ পড়তে হবে, বলাই বাহুল্য। আর কী আশ্চর্য, যুদ্ধের ব্যাকড্রপেও তো মেঘনাদের মতো রয়ে গিয়েছেন গম্ভীর। লখনউ বোলিং কোচ মর্নি মর্কেল সোজাসুজি বলে গেলেন যে, শনিবারের ম্যাচে গম্ভীরের মস্তিষ্ক বড়সড় ভূমিকা নিয়ে চলেছে। গম্ভীর, তিনি সবাই নিজেদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা উজাড় করে দেবেন পুরনো টিম কেকেআরকে হারাতে। পিঠোপিঠি সময়ে কেকেআর কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতও এসেছিলেন সাংবাদিক সম্মেলন করতে। তাঁকেও গম্ভীর নিয়ে ঘোরালো প্রশ্নের সামনে পড়তে হল। চন্দ্রকান্ত একটু চিবিয়ে-চিবিয়েই বললেন যে, ‘‘দেখুন, রাস্তা দু’টো। আপনি বিপক্ষ ডাগআউটে বসে থাকা গম্ভীরকে নিয়ে ভাবতে পারেন। কিংবা উলটো দিকের টিমটাকে নিয়ে ভাবতে পারেন। গম্ভীর কতটা কালকের ম্যাচে প্রভাব ফেলবে, আমার পক্ষে বলা মুশকিল। কিন্তু আমরা উলটো দিকের টিমটাকে নিয়েই ভাবছি।’’ এমনিতে পরিস্থিতি যা, তাতে শনিবার জিতলেও বিদঘুটে সব অঙ্ক অপেক্ষা করে থাকবে নাইটদের জন্য। অন্তত ১০৩ রানে জিততে হবে। তারপর অপেক্ষা করতে হবে আরসিবি এবং মুম্বইয়ের হারের। পণ্ডিত শুকনো গলায় বলে গেলেন যে, প্লে অফের ‘দুরাশা’ তিনি এখনও করেন। কিন্তু গলায় তেমন জোর ছিল না। বরং মনে হল, গম্ভীরের বিরুদ্ধে সম্মানের ম্যাচটা জিতলেই আইপিএল থেকে বিদায়বেলায় কেকেআরের পক্ষে যথেষ্ট হবে।
[আরও পড়ুন: হাই মাদ্রাসার ছাত্রীদের টেক্কা ছাত্রদের, আর্থিক সংকট কাটিয়ে প্রথম দরিদ্র পরিবারের সন্তান]
গম্ভীর–তিনি ভাবছেন তো নাইট নিয়ে? পুরনো টিমের বিরুদ্ধে মর্যাদার যুদ্ধ নিয়ে? প্রাক্তন কেকেআর অধিনায়কের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বললেন যে, সময় নেই। প্রথমত, তাঁর টিমের প্লে-অফ নিশ্চিত হয়নি এখনও। শনিবার জিতলে হবে। দ্বিতীয়ত, টিমের (Team India) ভারতীয় ব্যাটারদের গণ ব্যর্থতা। বলা হচ্ছে, কেএল রাহুলের অভাবের চেয়েও যা ভোগাচ্ছে বেশি টিমকে। একমাত্র আয়ুষ বাদোনি বাদে ভারতীয় ব্যাটাররা রান পাচ্ছেন না বলে মার্ক উডকে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। ইডেনের পিচে যা স্রেফ অপচয় হবে! সবচেয়ে বড় কথা, একটা অধরা মাধুরী এখনও আছে গম্ভীরের। অধিনায়ক হিসেবে আইপিএল জিতেছেন তিনি দু’বার। মেন্টর হিসেবে জিতলে জীবনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে। কেকেআর, বিরাট কোহলি– সব সেই প্রেক্ষাপটে ফুটনোট মাত্র। যাতে বেশি মন দিলে চলে না। আর কে না জানে, চ্যাম্পিয়নরা ‘ব্যাটল’ নয়, ‘ওয়ার’-এ বেশি মন দিতেই বরাবর পছন্দ করেন। গম্ভীরও বা বাদ যান কেন?