সুদীপ রায়চৌধুরি: এগলেস ট্যাগ থাকলেই কি সেই খাবার নিরামিষ? যেমন, এগলেস কেক? বা ধরা যাক আইসক্রিমের কথা! সেটা যে বিশুদ্ধ নিরামিষ খাবার, সে বিষয়ে কি একশো শতাংশ নিশ্চিত হওয়া যায়? এরকম অনেক খাবারই কিন্তু রয়েছে যা নিরামিষ ভেবে আমরা নিশ্চিন্ত থাকি!
সে যতই নিরামিষ হোক:
পাঁচতারা হোটেল ছেড়ে দিন, যে কোনও ভাল রেস্তোরাঁর রান্নায়, তা সে আমিষ হোক বা নিরামিষ, তাতে চিকেন বা মাটনের হাড়গোড় সেদ্ধ করা জল, যার পোশাকি নাম ‘স্টক’, ব্যবহার করাটাই দস্তুর৷ না হলে না কি প্রত্যাশিত ‘স্বাদ’-টাই আসবে না৷ বহু নিরামিষ রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেন, তাঁরা শুধুমাত্র ভেজিটেবল স্টক ব্যবহার করেন৷ কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই কিচেন স্টাফদের কথায় তার সমর্থন মেলেনি৷
এখানেই শেষ নয়৷ কেক, পেস্ট্রি, স্যালাড এমনকী আইসক্রিম খাওয়ার অর্থই আপনি কিছুটা হলেও ডিম খাচ্ছেন৷ কারণ ময়দা, দুধ, মাখন ইত্যাদির সঙ্গে এই খাবারগুলি বানাতে ডিম একটি অপরিহার্য উপকরণ৷
ঠান্ডা ঠান্ডা আমিষ:
যেমন ধরুন আইসক্রিম! সত্যি কথা বলতে কী, প্রকৃত অর্থে নিরামিষ আইসক্রিম বলতে কিছু হয় না৷ ইউরোপীয় রন্ধনশাস্ত্র অনুযায়ী আইসক্রিম বানাতে হলে দুধ, চিনি আর ডিম দিয়ে প্রথমে কাস্টার্ড তৈরি করে নিতে হবে৷ তারপর সেই মিশ্রণটি আইসক্রিম মেশিনে ঢেলে দিতে হবে৷ আর ডিম ছাড়া সত্যিকারের কাস্টার্ড বানানো সম্ভবই নয়৷
এদেশের ক্ষেত্রে কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সঠিক নয়৷ ভারতে কী বাড়িতে, কী রেস্তোরাঁয় রাঁধুনিরা কাস্টার্ড বানাতে ক্লাসিক্যাল পদ্ধতির বদলে কাস্টার্ড পাউডার ব্যবহার করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ৷ এই প্যাকেটজাত পাউডারে ডিম থাকে না এটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক যে প্রকৃত কাস্টার্ডের সঙ্গে এর পার্থক্যটা অনেকটা ব্রেড পকোড়া আর রাধাবল্লভীর পার্থক্যের কাছাকাছি৷
গল্প হলেও সত্যি:
এই কাস্টার্ড পাউডার আবিষ্কারের একটা দারুণ গল্প আছে৷ বার্ড নামে এক সাহেব এর আবিষ্কর্তা৷ ছোটবেলা থেকে কাস্টার্ড ছিল তাঁর বড় প্রিয়৷ মাঝবয়সে হঠাৎ করে তাঁর ডিমে অ্যালার্জি ধরা পড়ায় কাস্টার্ড খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়৷ ভগ্ণমনোরথ বার্ডসাহেব তখন লেগে পড়েন ডিম ছাড়া কাস্টার্ড বানানোর চেষ্টায়৷ শেষ পর্যন্ত একদিন তিনি কর্নফ্লাওয়ার ও অন্য কিছুর মিশ্রণে একটি পাউডার বানালেন, যা ফুটন্ত দুধে মেশালে কাস্টার্ড তৈরি হচ্ছে৷ নিজের নামে সেই পাউডার প্যাকেটবন্দি করে বাজারজাত করতে দেরি করেননি বার্ডসাহেব৷
ডিমবিহীন কাস্টার্ড বানানো গেলেও কিন্তু ডিমবিহীন আইসক্রিম বানানো সম্ভব নয়৷ যদিও আমাদের দেশে যে সমস্ত আইসক্রিম হইহই করে বিক্রি হয়, তাতে ডিমের নামগন্ধ নেই৷ এবং সেজন্য নিরামিষাশীদের উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করারও কারণ নেই৷ কারণ ডিমের পরিবর্তে এগুলিতে ‘স্টেবিলাইজার’ ও ‘ইমালসিফায়ার’ হিসাবে গাদাগুচ্ছের কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়৷ সঙ্গে মেশিনের সাহায্যে দুধের মিশ্রণে বাতাস পাম্প করে ‘বাবলস’ বা বুদবুদ সৃষ্টি করা হয়৷ যে কারণে এগুলি আইনত ‘আইসক্রিম’ নামে বিক্রি করা হয় না৷ বিক্রি করা হয় ‘ফ্রোজেন ডেজার্ট’ নামে৷ প্যাকেটের গায়ে সেটাই লেখা থাকে, ‘আইসক্রিম’ কদাচ নয়৷ বিদেশি নামকরা আইসক্রিমের তুলনায় স্বাদ জঘন্য!
আইসক্রিমে ডিম:
সত্যিকারের আইসক্রিম বানাতে হলে আজও ডিমের কোনও বিকল্প নেই৷ ডিমের কুসুম যত বেশি হবে, আইসক্রিমের স্বাদ ও টেক্সচার তত মোলায়েম হবে৷ যে কারণে ‘হায়গেন ডায়স’ বা ‘বাসকিন রবিন্স ইউকে’-র মতো বিশ্ববিখ্যাত আইসক্রিম কোম্পানিগুলি তাদের ওয়েবসাইটে সোচ্চারে ঘোষণা করে যে তারা ডিম ছাড়া কোনও কৃত্রিম রাসায়নিক ‘স্টেবিলাইজিং’-এর জন্য ব্যবহার করে না (এদেশে অবশ্য বাসকিন রবিন্স কী করে তা পরিষ্কার নয়)৷ এর কারণ ইউরোপ ও আমেরিকাবাসীর স্বাস্থ্যসচেতনতা৷ ডিমের পরিবর্তে স্টেবিলাইজিংয়ের জন্য যে রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়, সেগুলির অপকারিতা কতটা তা ওদেশের লোকেরা ভালই জানেন৷ তাই সবসময়ই ‘ন্যাচারাল ইনগ্রেডিয়েন্টস’ বা প্রকৃতিজাত উপকরণের প্রতি তাঁদের ভরসা৷ আর আমরা ধর্মীয় সংস্কার ঠিক রাখতে প্রাকৃতিক উপকরণের জায়গায় গাদা গাদা ক্ষতিকর রাসায়নিক অবলীলায় খেয়ে থাকি৷ বাজারে ‘এগলেস মেয়োনিজ’ বা ‘এগলেস কেক’-এর প্রবল কাটতি তারই প্রমাণ৷ বিদেশে গিয়ে অবশ্য ডিম খাই না-জেনে৷ কারণ সেখানে আইসক্রিমে উপাদান হিসাবে ডিম-ই থাকে৷
জুড়ি মেলা ভার:
খাদ্যবিজ্ঞানে সহজলভ্য ও সস্তা প্রোটিন খাদ্য হিসাবেই শুধু ডিমের কদর নয়, এর মূল কদর প্রাকৃতিক ইমালসিফায়ার হিসাবে৷ দুটি পৃথক চরিত্রের ও ঘনত্বের তরলকে একসঙ্গে মেশানোর ক্ষেত্রে বাঁধন বা ‘বন্ডিং’ আনতে ডিমের জুড়ি নেই৷ মেয়োনিজ বানানোর সময় যেহেতু দুধ (যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে জল বা জলীয় পদার্থ থাকে) এবং তেলকে ভাল করে মেশাতে হয়, তাই ডিমই এক্ষেত্রে সেরা বন্ডিং মেটিরিয়াল৷ এগলেস মেয়োনিজের অর্থ ডিমের পরিবর্তে সেই ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার৷ এগলেস কেকের ক্ষেত্রেও একই কথা৷
পেস্ট্রি বা প্যাটিস বা সালাডের ক্ষেত্রে ডিম একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান৷ বেক করার আগে গায়ে ডিমগোলার ব্রাসিং না দিলে পেস্ট্রি-প্যাটিসে প্রত্যাশিত উজ্জ্বল সোনালি রংটাই আসবে না৷ পেস্ট্রির ক্ষেত্রে উপরের ক্রিমের টপিংটা বানানো হয় ক্রিম, চিনি ও ডিমের সাদা অংশকে একসঙ্গে ফেটিয়ে৷ এক্ষেত্রে ‘এগলেস’ অর্থই হচ্ছে সস্তার ইন্ডাসট্রিয়াল ক্রিম ব্যবহার করা৷ যা তৈরি হয় সাদা তেল, চিনি ও রাসায়নিক মিশিয়ে৷ বাজারে অধিকাংশ পেস্ট্রি বা ক্রিম রোলে এই বস্তুটাকেই ‘ক্রিম’ বলে চালানো হয়৷
পাপ-পুণ্য:
একটা ছোট্ট ও চমৎকৃত করে দেওয়ার মতো তথ্য দেওয়া যাক! ব্যাকরণগতভাবে এই কয়েক মিলিয়ন নিরামিষাশী ভারতবাসী অনায়াসে ডিমজাত আইসক্রিম বা মেয়োনিজ বা কেক খেতে পারেন৷ যে কারণে হিন্দু ধর্মে আমিষ ভক্ষণ নিয়ে আপত্তি, তা এই ডিমে নেই৷ আমিষাহার নিয়ে গোঁড়া হিন্দুদের আপত্তির কারণ এর সঙ্গে প্রাণীহত্যার মতো পাপজড়িত৷ মাছ-মাংসের মতো ডিমও জীবন্ত বস্তু৷ এর মধ্যে অজাত প্রাণ থাকে৷ একদম ঠিক! কিন্তু আমরা ভুলে যাই, বাজার থেকে যে ডিম আমরা সচরাচর কিনি, সেই পোল্ট্রি এগ বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এগ একটি আদ্যন্ত অনিষিক্ত ডিম৷ এই ডিমের ভিতর কোনও প্রাণ নেই৷ ঠিক যে কারণে রক্ত থেকে সৃষ্টি হলেও দুধ একটি আদ্যন্ত নিরামিষ পানীয়৷ এই ডিম সৃষ্টিতে কোনও পুরুষ অর্থাৎ মোরগের ভূমিকা নেই৷ তাই এই ডিমের উপর বসে মা মুরগি টানা দু’শো বছর ‘তা’ দিলেও ডিম ফুটে ছানা বেরোবে না৷ ফলে এই ডিম খেলে কোনও প্রাণ-হত্যার পাপ হবে না৷ তাই এই ডিম খাওয়ার সঙ্গে দুধ বা ছানা খাওয়ার কোনও পার্থক্য নেই৷
The post নিরামিষ ভেবে যা খাচ্ছেন, তাতে আমিষ নেই তো? appeared first on Sangbad Pratidin.