অর্ণব আইচ: দাদাদের কথা না শোনার শাস্তি কখনও ‘রেলিং ওয়াক’। কখনও হস্টেলের তিনতলা, কখনও আবার চারতলার বারান্দার কংক্রিটের পাঁচিল বা রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটতে হবে ‘অবাধ্য’ নবাগতকে। ক্ষেত্রবিশেষে জামাকাপড় খুলিয়ে হাঁটানো হবে। সামান্য ব্যালান্স হারালেই যে সাক্ষাৎ মৃত্যু (Death), তা জেনেও যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেলের (Jadavpur University Main Hostel) সিনিয়র দাদারা নাকি হস্টেলে নতুন আসা ছাত্রদের উপর আকছার এ ধরনের অত্যাচার চালায়!
সম্প্রতি হস্টেলের নিরাপত্তারক্ষী ও রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের হাতে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। যার প্রেক্ষিতে তদন্তকারীরা এখন জানার চেষ্টা করছেন, গত বুধবার রাতে যাদবপুরের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রটিকেও রেলিংয়ে জবরদস্তি হাঁটানো (Walk)হয়েছিল কি না। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে ধৃত যাদবপুরের এক প্রাক্তনী ও দুই ছাত্রকে জেরা করেও এই ব্যাপারে পুলিশ বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে। তারই ভিত্তিতে সোমবার লালবাজারের (Lalbazar) সায়েন্টিফিক উইংয়ের আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে এই ঘটনার পুনর্গঠন করেন ডিসি (এসএসডি) বিদিশা কলিতা। তিনতলার বারান্দার পাঁচিলের উপর থেকে ভারী বস্তু ফেলে দেখা হয়, ছাত্রটি কীভাবে তিনতলার বারান্দা থেকে পড়েছেন।
মৃত ছাত্রের বাবার অভিযোগ অনুযায়ী, তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, নাকি সে বারান্দা থেকে লাফ দিয়েছে, নাকি তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটতে বলা হয়েছিল, বৈজ্ঞানিক উপায়ে তা জানার চেষ্টা হয়। কোন অবস্থায় পড়ে গেলে যে জায়গায় দেহটি পড়তে পারে, তা জানতে শুরু হয়েছে তদন্ত। ডিসি (এসএসডি) জানান, এদিন সন্ধ্যায় হস্টেল থেকে আরও এক ছাত্রকে যাদবপুর থানায় নিয়ে এসে জেরা করে এই ঘটনায় তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে জানার চেষ্টা হচ্ছে।
[আরও পডুন: লালকেল্লায় মোদির মুখে মণিপুর, ‘শান্তি ফিরছে’, বললেন প্রধানমন্ত্রী]
এদিকে, মৃত পড়ুয়ার বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় সে নাবালক বলে জানিয়েছে শিশু সুরক্ষা কমিশন। সেইমতো কমিশন ছাত্রের মৃত্যুতে পুলিশকে পকসো আইনে মামলা শুরু করার পরামর্শ দেয়। যদিও এদিন আলিপুর আদালতে পকসো (POCSO) আইনের ধারা যুক্ত করার আবেদন জানায়নি পুলিশ। এই ব্যাপারে লালবাজারে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। আইন অনুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ এই ব্যাপারে অগ্রগতির জন্য এদিন পুলিশ আধিকারিকরা এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গে গিয়ে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তথা চিকিৎসকদের পরামর্শ নেন। গত বুধবার ঘটনার দিন ছাত্র পড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে যাদবপুর থানার পুলিশ হস্টেলে যায়। কিন্তু পুলিশকে তখন হস্টেলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। এই ব্যাপারে এদিন হস্টেলের ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে নতুন একটি মামলা দায়ের হয়েছে।
এদিকে, মৃত পড়ুয়ার হস্টেলটিতে বিভিন্ন বিভাগের আরও প্রায় এক ডজন প্রথম বর্ষের ছাত্রও থাকতেন বলে পুলিশ জেনেছে। মৃত ছাত্রের মতো ওই ছাত্ররাও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কি না, সেই তথ্য জানতে এদিন তাঁদের যাদবপুর থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ জেনেছে, বুধবার হস্টেলের চারতলায় ১০৪ নম্বর ঘরে নিয়ে গিয়ে ওই মৃত ছাত্রটিকে বাংলা বিভাগের এক সিনিয়র ‘রুদ্রদা’র নাম করে ‘ডিন অফ স্টুডেন্টস’কে চিঠি লিখতে জোর করা হয়। সে নিজের ডায়েরির পাতায় ওই চিঠি লিখতে না চাইলে অত্যাচার শুরু হয়। অত্যাচারের সময় সে ফোন করে মাকে জানানোর চেষ্টা করে, সে ভয় পাচ্ছে। তখন ধৃত প্রাক্তনী সৌরভ চৌধুরী ফোন কেড়ে নিয়ে পড়ুয়াটির মাকে জানায়, তাঁর ছেলে ভাল আছে।
[আরও পডুন: ‘দোষীদের শাস্তি দেবই’, যাদবপুরের ছাত্রের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কান্নাভেজা চোখে শপথ বাবার]
এরপর ডায়েরিতে চিঠিটি লেখে হস্টেলের আবাসিক ছাত্র দীপশেখর দত্ত, যাকে ইতিমধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু সাদা পাতায় না লিখে কেন ডায়েরির পাতায় চিঠি লেখা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওই চিঠিতে পড়ুয়ার সইটিও ভুয়ো বলে অভিযোগ। ওই সইটি কোন সিনিয়র ছাত্র করেছিলেন, পুলিশ তা জানার চেষ্টা করছে। আবার এমনও সম্ভাবনা রয়েছে যে, নিজেদের পিঠ বাঁচাতে নাবালক ছাত্রটির মৃত্যুর পর ধৃত সৌরভ ও তার অনুগামীরা চিঠি লিখে ভুয়ো সই করে। এই ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হতে ধৃতদের জেরা করার সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘটনার সময় উপস্থিত, এমন আরও কয়েকজনকে জেরা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।