স্টাফ রিপোর্টার, নয়াদিল্লি: সময় বদলায়। বদলায় ক্ষেত্র। কিন্তু, বদলায় না স্বৈর-শাসকের মনোভাব। সাত বছর আগের এমনই এক নভেম্বর। সর্বভারতীয় একটি সংবাদ চ্যানেলকে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রের মোদি সরকার। দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় উঠেছিল। সেই প্রতিবাদে শাসকের মনোভাব যে বিন্দুমাত্র বদলায়নি, মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর বুকে ফের তা প্রমাণিত হয়ে গেল। ২০২৩ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সংবাধমাধ্যমের স্বাধীনতায় ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে রয়েছে ভারত। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে যা সর্বনিম্ন।ফের সেকথা মনে করিয়ে দিল মোদি সরকার।
ফের দেশের তামাম সাংবাদিক, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কমেডিয়ানের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালাল দিল্লি পুলিশ। যে দিল্লি পুলিশের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মন্ত্রকের হাতে। এ দিনের তল্লাশিতে বাজেয়াপ্ত করা হল অনেকের মোবাইল, ল্যাপটপ। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে থানায় চলল দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ। এই ঘটনার পরই দেশজুড়ে শুরু হয় প্রবল সমালোচনা। সরব হন দেশের তামাম সাংবাদিকরা। সাংবাদিকদের এভাবে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনার তীব্র নিন্দা করে ‘দ্য প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া’। তারা ‘ডিফেন্ডমিডিয়াফ্রিডম’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করতে শুরু করে। একটি বিবৃতি জারি করে প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া জানায়, নিউজক্লিক-এর (Newsclick) সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক এবং লেখকদের বাড়িতে এই তল্লাশি খুবই উদ্বেগের। তারা এই গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের উপর এভাবে আঘাতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি জারি করে কলকাতা প্রেস ক্লাবও। চাপ বাড়ছে বুঝতে পেরে দিনের শেষে অনেকটাই পিছু হটে দিল্লি পুলিশ। একে একে ছাড়া হয় সাংবাদিক-সমাজকর্মীদের।
প্রসঙ্গত, ঘটনার সূত্রপাত গত আগস্টে। সে সময় চিনা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে নিউজক্লিকের অন্যতম মালিক নেভিল সিংহমের বিরুদ্ধে। তার পরেই নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের। ১৭ আগস্ট করা এফআইআর। আর তার ভিত্তিতে এই পুলিশি অভিযান। মামলা রুজু হয় ইউএপিএ আইনে। যাঁদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে তাঁদের তিনটি ক্যাটেগরিতে (এ, বি, সি) ভাগ করা হয়েছিল। ‘এ’ ক্যাটেগরি তালিকায় থাকাদের আটক করা হয়। নিউজক্লিক-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয়। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হন সংস্থার কর্মী অমিত চক্রবর্তী।
[আরও পড়ুন: পাখির চোখ লোকসভা নির্বাচন? ২০২৪ সালের গোড়াতেই বন্দে ভারতে থাকবে স্লিপার কোচ]
সূত্রের খবর, অনেক সাংবাদিক-লেখকদের অবশ্য এই ধারার ইউএপিএ বাইরেই রাখা হয়েছিল। দিল্লি পুলিশ জানায়, মোট ৪৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জন মহিলা। আবার, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটও (ইডি) একটি মামলা রুজু করে। তদন্তকারী সংস্থার কাছ থেকে তথ্য পেয়েই তল্লাশি অভিযানে নামে দিল্লি পুলিশ। দিল্লি, নয়ডা, গাজিয়াবাদ, গুরুগ্রাম এবং মুম্বইয়ে একশোরও বেশি জায়গায় মঙ্গলবার সকাল থেকে তল্লাশি অভিযান চালায় দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল। তল্লাশি চালানো হয় এই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকা বেশ কিছু সাংবাদিক, কর্মীর বাড়িতেও।
সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদ এবং প্রবীণ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। সংবাদকর্মী, ভিডিও সাংবাদিক অভিসার শর্মা, সিনিয়র সাংবাদিক ভাষা সিং, প্রবীণ সাংবাদিক উর্মিলেশ, নিউজক্লিকের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং লেখক গীতা হরিহরণ, অর্থনীতিবিদ অনিন্দ্য চক্রবর্তী, সমাজকর্মী ও ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমি এবং স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান সঞ্জয় রাজৌরার বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি অভিযান চলে। তাঁদের বাড়ি থেকে বিশেষ অফিসে নিয়ে গিয়ে চলে জিজ্ঞাসাবাদ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই পর্ব। এই তল্লাশি-অভিযানের কারণ কী?
[আরও পড়ুন: নাগাড়ে বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত সিকিমে নিখোঁজ ২৩ সেনা জওয়ান, প্লাবিত উত্তরবঙ্গও]
বেশ কয়েক দিন আগেই নিউজক্লিকের আর্থিক অনুদান নিয়ে তদন্ত শুরু করে ইডি। ইডি এর আগে অভিযোগ করেছিল যে, এই নিউজ পোর্টালটি চিনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলির কাছ থেকে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে এবং এই এত টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তার পরই যাঁরা নিউজক্লিক থেকে বেতন বা পারিশ্রমিক পেয়েছেন তাদের নজরে রাখা শুরু হয়। আবার নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, নিউজক্লিক টাকা নিয়েছে নেভিল সিংহমের কাছ থেকে। যিনি আসলে চিনের সরকারি মিডিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। ইডি, নিউজক্লিকের প্রবর্তক এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে নেভিল রায় সিংহমের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলি থেকে নিউজক্লিক স্টুডিও প্রাইভেট লিমিটেডে ৮৬ কোটি টাকারও বেশি বিদেশি অনুদান আসার অভিযোগে তদন্ত করছে। ইডি’র আরও দাবি, ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থ এবং ট্রাইকন্টিনেন্টাল এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বিজয় প্রসাদকে নেভিল রায় সিংহম একটি ইমেল পাঠান যেখানে একটি চিনা প্রচারমূলক চলচ্চিত্রের সাবটাইটেলিংয়ের কথাও বলা হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। নিউজক্লিক থেকে কর্মী তিস্তা শীতলাবাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার ফান্ড ট্রান্সফার, সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, নিউজক্লিকের কিছু কর্মচারীকে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা পাঠানোর অভিযোগও এনেছে তদন্তকারী সংস্থা। আরও অভিযোগ, নিউজক্লিক জেলবন্দি সমাজ কর্মী গৌতম নাভলাখাকে বেতন হিসাবে ১৭.০৮ লক্ষ টাকা, শেয়ারহোল্ডার তথা সিপিআই (এম)-এর আইটি সেলের সদস্য বাপ্পাদিত্য সিনহাকে ৯৭.৩২ লক্ষ টাকা দিয়েছে।
[আরও পড়ুন: দিল্লির লড়াই এবার কলকাতায়, লক্ষ লোক নিয়ে রাজভবন কাঁপানোর ডাক অভিষেকের]
এই গুচ্ছ অভিযোগে, ৫০০ পুলিশকর্মীকে নিয়ে একশোর বেশি জায়গায় এই তল্লাশি অভিযান ঘিরে শুরু হয় চূড়ান্ত রাজনৈতিক চাপানউতোর। প্রসঙ্গত, ‘নিউজক্লিক’ কাণ্ডে মঙ্গলবার সকালে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির বাড়িতে তল্লাশি চালাল দিল্লি পুলিশ। যে বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে, সেটি ৩৬ নম্বর পণ্ডিত রবিশঙ্কর শুক্ল লেন। যেটি আগে ক্যানিং লেন নামেই পরিচিত ছিল। ওই বাড়ির একটি তলে থাকেন নিউজক্লিক-এর এক সাংবাদিক। ঘটনাচক্রে, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তরে কাজ করেন ওই যুবকের বাবা শ্রীনারায়ণ। যুবকের ল্যাপটপ এবং মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়। এ
এই তল্লাশি প্রসঙ্গে ইয়েচুরি বলেন, “ওরা কীসের তল্লাশি চালাচ্ছে, কেন চালাচ্ছে, কেউ জানে না। যদি সংবাদমাধ্যমকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা হয়, তা হলে দেশের মানুষের জানা উচিত, এর পিছনে কী কারণ রয়েছে।” এভাবে তল্লাশি অভিযানের কড়া সমালোচনা করেছে কংগ্রেস-আপ-এসইউসিআই-র মতো বিরোধীরা। যদিও স্বাভাবিকভাবেই উলটো সুর শোনা গিয়েছে কেন্দ্রের মুখে। কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “এ তল্লাশি প্রসঙ্গে মন্তব্য করাটা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করি না। যদি কেউ দোষ করে থাকেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। তদন্তকারী সংস্থা আইন মেনেই তদন্ত করে।”