শহরের চারপাশে চূড়ান্ত মন-খারাপ করা ঘটনা। সঙ্গে রোজকার জীবনের চাপ। তার উপর শীতকাল। সেই ডিপ্রেশন কাটানোর পথ দেখাচ্ছেন গৌতম ব্রহ্ম।
হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি নেই। ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারও ব্ল্যাক। শুধু স্টেটাস আছে- আমি ডিপ্রেশনে আছি। ব্রেক-আপ, অফিসের চাপ, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই, বাচ্চার সমস্যা তো আছেই, তার থেকেও ভয়ানক সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেও ‘কিছুই করতে পারিনি’- এই চিন্তা। সঙ্গে যোগ করুন চারপাশে ঘটে যাওয়া চূড়ান্ত মনখারাপ করে দেওয়া ঘটনা। যার থেকে হতাশা ও ডিপ্রেশন।
কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম! এই ভাবনাতেই ডিপ্রেশনের হাতছানি। মনে পড়ছে ‘যব উই মেট’ ছবির একটা দৃশ্য। প্রাণোচ্ছল, জীবনকে প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করা গীতের জীবনে ব্রেক-আপ কী সাংঘাতিক পরিণতি এনেছিল। সেই ডিপ্রেশন থেকে গীতকে বের করেছিল সময় নয়, বন্ধু আদিত্যর সঙ্গ আর মনের জোর। এইরকম অজস্র ঘটনা আছে, যেখানে ডিপ্রেশন ওলটপালট করে দিয়েছে সাজানো একটা জীবন।
ঘটনা ১
একজোড়া তরুণ-তরুণী শ্যামবাজারের এক সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে হাজির। উদ্দেশ্য প্রি-ম্যারিটাল কাউন্সেলিং। বিয়ের পর কী কী সমস্যা হতে পারে, তার আগাম ধারণা দিতে হবে। ডিভোর্সের ঝুঁকি কমাতে আগেভাগে পরস্পরের মন পরীক্ষা করিয়ে নিলেন।
ঘটনা ২
মাঝবয়সি এক ‘ওয়ার্কিং লেডি’ অফিস ফেরার পথে দক্ষিণ কলকাতার এক নামী সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে ঢুকে ডাক্তারকে জানালেন, “বেক ডিপ্রেশন অ্যান্ড অ্যাংজাইটি স্কেলে আমার ডিপ্রেশন স্কোর ১৭। মনে হচ্ছে মডারেট ডিপ্রেশনে ভুগছি।” মহিলা দীপিকা পাড়ুকোনের রেফারেন্সও দেন। বলেন, “আমারও অকারণে পেট গুড়গুড় করছে। কান্না পাচ্ছে। খিদে, ঘুম কমে গিয়েছে।”
[ চারুর চোখে অমল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে স্মৃতিচারণা মাধবীর ]
আগে এই ধরনের ‘কেস’ সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসতই না। মানুষ মনেই করত না, শরীরের মতো মনেরও চিকিৎসা দরকার হতে পারে। আগে মানুষ মন খারাপকে পাত্তা দিত না। কিন্তু মিডিয়ায় লেখালেখির জন্য হোক বা দীপিকা পাড়ুকোনদের ‘হ্যাশট্যাগ নটঅ্যাশেমড’ অভিযানের দৌলতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে আমজনতার সঙ্কোচ অনেক কমেছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের মধ্যেও এই ট্রেন্ড এখন চোখে পড়ার মতো। এমনটাই জানালেন আরজি কর হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. রাজর্ষি নিয়োগী। তাঁর পর্যবেক্ষণ, আসলে রোগীদের একটা বড় অংশ আসছে গুগল ঘেঁটে। গুগলের বিভিন্ন সাইটে গিয়ে নিজেদের হতাশার বিভিন্ন উপসর্গ টাইপ করছেন। বিভিন্ন কোয়েশ্চেনেয়ার পূরণ করে জেনে নিচ্ছেন নিজেদের ডিপ্রেশন স্কোর। তারপর হাজির হয়ে যাচ্ছেন সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্টদের চেম্বারে। আগে সেক্সুয়াল সমস্যা হলে আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের কাছে যেতেন মানুষ। এখন কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসছেন। এই সচেতনতা এখন তৈরি হয়েছে।
সফটওয়ের ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর মানুষ আজকাল মনোবিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। বেশিরভাগই পেশার দৌড়ে হতাশার চোরাবালিতে তলিয়ে নেশার আবর্তে ঢুকে পড়েছেন। সেই চক্রব্যূহ থেকে বেরোতেই এই পদক্ষেপ। এমনটাই জানালেন সাইকোলজিস্ট স্মিতা সিং। তাঁর পর্যবেক্ষণ, সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়েরাও আগের থেকে মনোবিদ ও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে বেশি আসছেন। মাস ছয়েক আগের কথা। ভিডিও গেমে আসক্ত একটি ছেলে নিজের মৃত্যুচিন্তার কথা গুগলে শেয়ার করেছিল। ওয়েবসাইট তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিতে বলে। ছেলেটি বাবা-মায়ের সাহায্য নিয়ে মনোবিদের কাছে আসে।
গানবাজনা, অভিনয়, মডেলিংয়ের জগতের সেলিব্রিটিরাও মনের ডাক্তারের দরজায় নিয়মিত ভিড় জমাচ্ছেন। এমনই পর্যবেক্ষণ সিনিয়র কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট তথা ‘ক্রিস্টাল মাইন্ডস’-এর প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা ডা. রিমা মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর মত, এখন কাউন্সেলিং শব্দটা খুব পরিচিত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্রই কাউন্সেলিং সেন্টার খোলা হচ্ছে। ক্যাম্প হচ্ছে। শিক্ষকরা ছাত্রকে গাইড করছেন। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে চেম্বারে পাঠাচ্ছেন। বড় বড় স্কুল কাউন্সেলিং সেশন রাখছে। সাইকিয়াট্রিস্টের পরিসর যে অনেক বড় সেই বোধটা সাধারণের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
[ ‘উরি’-তে কীভাবে ভিভান সিং শেরগিল হয়ে উঠলেন ভিকি? ]
রিমা, রাজর্ষি, স্মিতা, প্রত্যেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদদের চেম্বারে ‘ফুটফল’ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আসলে গত দশ বছরে সমাজে অনেক বদল এসেছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব এসেছে। তার জেরেই নতুন ধরনের কিছু মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। রিমা জানালেন, বাচ্চাদের মধ্যে মোবাইল অ্যাডিকশন সাংঘাতিক বেড়ে গিয়েছে। বয়ঃসন্ধির সময় এই শিশুরাই আসক্ত হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপে। সারাক্ষণ ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে থাকার ফলে সামাজিক সম্পর্কগুলি সেভাবে দানা বাঁধছে না। একাকিত্ব দূর করতেও অনেকে ফেসবুকে আসক্ত হচ্ছে।
এখন যৌনতা নিয়েও অনেক বেশি খোলাখুলি কথা হচ্ছে। সমকামিতা নিয়ে কথা বলতে সেভাবে আর কেউ সঙ্কোচ বোধ করছেন না। সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নিচ্ছেন। ‘ম্যারিটাল ডিসহারমনি’ বা দাম্পত্য কলহ আগের থেকে অনেক বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এর পিছনেও ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড অনেকটা দায়ী। একাকিত্ব কমাতে স্বামী বা স্ত্রী মেসেঞ্জারে গিয়ে সমব্যথী খুঁজে নতুন সম্পর্ক গড়ছেন। সংসারে অশান্তি বাধছে। আর বয়স্করা প্রযুক্তিকে ভয় পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। অপরিচিত নম্বর থেকে এসএমএস এলে, ফোন এলে ভয় পাচ্ছেন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে যাওয়ার ভয় চেপে বসছে অশীতিপর ঘাড়ে। এমনই অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন রিমা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “বয়স্করা স্মৃতিভ্রংশ বা ‘ডিমেনশিয়া’ নিয়ে আগেও এসেছেন, এখনও আসছেন। কিন্তু ইদানীং দেখছি, মানসিক অসুখে আক্রান্ত বাবা-মায়ের পরিচর্যা করতে গিয়েও অনেক সন্তান মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বাবা-মায়ের শারীরিক সমস্যা ছেলেমেয়েরা মেনে নিতে পারছেন। কিন্তু মানসিক পরিবর্তন পারছেন না। এর জন্য পরিবারের গঠনগত পরিবর্তনও দায়ী।”
প্রকৃতিগতভাবেই ভারতীয়রা হতাশার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে খানিকটা গুটিয়ে থাকে। বরং হতাশার জন্য তৈরি হওয়া উপসর্গকে রোগ ভেবে জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে দৌড়য়। হতাশার কারণে কেউ অনিদ্রার শিকার হতে পারেন। হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। মাথা যন্ত্রণা করতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য তো খুব সাধারণ সমস্যা। বমি বমি ভাবও আসে অনেকের। এখন যদি কেউ শুধু হজমের ওষুধ বা বমির ওষুধ খায় তবে সাময়িক স্বস্তি মিললেও হতাশা কাটবে না। উপসর্গগুলির উৎসের সন্ধানে নামতে হবে। আর সেটা একজন সাইকিয়াট্রিস্টই করতে পারেন। এই বিশ্বাস সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। ‘লিভ লাভ লাফ’ ফাউন্ডেশন গড়ে এই কথাই বলার চেষ্টা করছেন দীপিকা। সম্প্রতি প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, রবীনা ট্যান্ডনও হতাশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন।
আজকাল অনেকেই দীপিকার মতো নিজে থেকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসছেন। কথা বলছেন। এটা খুব ভাল লক্ষণ। উৎস না জানলে রোগের চিকিৎসা করা সত্যিই মুশকিল। গোড়া কেটে যাওয়া গাছে জল দেওয়ার মতো। তবে, এই বিষয়ে ডাক্তারকুলকেও সচেতন হতে হবে। এমনটাই জানালেন পিজি হাসপাতালের ‘ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’-র অধিকর্তা ডা. প্রদীপ সাহা। তাঁর বক্তব্য, অনেক ডাক্তার রোগীর মানসিক সমস্যার বিষয়টি ইচ্ছে করে বাইপাস করে যান। তবে ইদানীং সরকারি স্তরে মনোরোগ নিয়ে সিরিয়াসনেস অনেক বেড়েছে। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে মনোরোগের আলাদা ওয়ার্ড হয়েছে। আউটডোর তো চলছেই। ফলে, সচেতনতা বাড়ছে।
[ শহরের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই চেনা শব্দগুলো ]
বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের। কারণ এই দুই প্ল্যাটফর্মে মনের দুঃখটা ভাগ করে নেওয়া যায়। বোঝা যায়, এই দুঃখের পৃথিবীতে আপনি একা নন। দেখবেন বুকে জোর পাবেন।
ইচ্ছে হলে মন খুলে কাঁদুন। এখন তো লাফিং ক্লাবের পাশাপাশি উইপিং ক্লাবও হচ্ছে। যেখানে আপনি বিজ্ঞানসম্মতভাবে কাঁদতে পারবেন।
পুরো জীবনটা শুধু সুখেই কেটে যাবে, এই ভাবনাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। ছোটখাটো দুঃখ-কষ্ট জীবনে আসবেই, হতাশাও আসবে। এরই নাম জীবন।
অবসাদ কাটাতে
- নিজেকে একা ভাবা বন্ধ করুন।
- আমাকে কেউ ভালবাসে না, কেউ আমায় বোঝে না, এই চিন্তাটা মারাত্মক। আপনিই আপনার সব থেকে ভাল বন্ধু। মানুষ নিজেকেই সব থেকে বেশি ভালবাসে। তাই কে ভালবাসল, কে বাসল না, ডোন্ট কেয়ার।
- ব্রেক-আপ মেনে নিতে চেষ্টা করুন। সময় নিন। বদল আনুন রোজকার রুটিনে। যেটা পেলেন না তার কথা না ভেবে যা পেয়েছেন তাই নিয়ে ভাবুন।
- সারাদিনে নিজের জন্য একটু সময় রাখুন। ওই সময়টা শুধু আপনার। ওই সময় আপনার যেটা করতে ভাল লাগে সেটাই করুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
- আপনার বন্ধুর লিস্টে বিভিন্ন বয়সের বন্ধু থাকুক। মাঝে মাঝে ফ্লার্ট বা পিএনপিসি করুন। মন হালকা থাকবে।
- সময় থাকলে মেডিটেশন করুন।
The post মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভিতর ‘ডিপ্রেশনের’ দিস্তা… appeared first on Sangbad Pratidin.