বিশ্বদীপ দে: দেখতে দেখতে ৭৫ বছর হয়ে গিয়েছে ভারতের স্বাধীনতার। তবু শতকের সিকি দূরত্বের এপার থেকে তাকিয়ে বারবার আমাদের বুঝে নিতেই হবে সেই মহার্ঘ্য মুহূর্তটি ‘কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা’। এইসব বলিদানের ইতিহাস বারবার পুনরাবৃত্ত হওয়া দরকার। যাতে স্বাধীনতার মূল্যটি প্রকট হয়ে উঠতে পারে। আর সেই ইতিহাসের কথা বলতে বসলে একেবারে সামনের সারিতেই থেকে যায় ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ তারিখটি। লাহোর সেন্ট্রাল জেলে সেদিন ফাঁসি হয়েছিল তিন যুবকের- ভগৎ সিং (Bhagat Singh), রাজগুরু ও সুখদেব। তাঁদের শোকে সকালের রোদও যেন হয়ে উঠেছিল পাণ্ডুর। বহু মানুষ সেদিন ছিলেন অভুক্ত। কালো ব্যাজ পরে অনেকেই প্রত্যক্ষ ভাবে এই ফাঁসির প্রতিবাদ করেছিলেন।
ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি নিয়ে কথা বলতে বসলে অবধারিত ভাবেই উঠে আসে মহাত্মা গান্ধীর প্রসঙ্গও। একটা মত বলে, গান্ধী (Mahatma Gandhi) চাইলেই কিন্তু আটকাতে পারতেন ওই ফাঁসি। কিন্তু যেহেতু ভগৎদের পথ আর তাঁর পথ এক নয়, তাই তিনি যথেষ্ট সচেষ্ট হননি। এবং অবশ্যই রয়েছে উলটো মতও। এই লেখায় আমরা একবার ফিরে দেখব সেই বিষয়টি।
ভগৎ সিংকে যেভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তা আসলে আইনের সঠিক পথে হয়নি। হংসরাজ ভোরা, ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, জয় গোপাল, মনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তাঁর সঙ্গীরা কেউ অর্থ, বৃত্তি, জমির বিনিময়ে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ভগৎ সিংয়ের নাম। ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল যেভাবে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতেই হবে। আর তাই ভাইসরয় এমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করেন। একটা স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হয় বিচারের জন্য। সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি অর্থাৎ ব্রিটিশ সংসদের অনুমতি ব্যতিরেকেই অর্ডিন্যান্স পাশ করা হয়েছিল। পুরো বিষয়টিই ছিল আসলে বেআইনি। কিন্তু ব্রিটিশরাজের হাতেই যখন বিচারের মানদণ্ড, তখন তাদের কথাই শেষ কথা।
[আরও পড়ুন: ভাত-কাপড়ের অঙ্গীকার ভুললে চলবে না, খোরপোশ দিতেই হবে, নির্দেশ কলকাতা হাই কোর্টের]
আর এই পরিস্থিতিতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু শেষপর্যন্ত আটকানো যায়নি ভগৎ-সুখদেব-রাজগুরুর ফাঁসি। আর তাই ১৯৩১ সালে করাচিতে কংগ্রেসের অধিবেশনে রীতিমতো বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় গান্ধীকে। স্লোগান ওঠে, ‘গো ব্যাক গান্ধী’, ‘লং লিভ ভগৎ সিং’। পরবর্তী সময়ে ভগৎ সিংয়ের জীবনীকার জি এস দেওল গান্ধীকেই ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির জন্য দায়ী বলে দাবি করেন। একই কথা বলতে শোনা গিয়েছিল ভগতের এক বিপ্লবী সঙ্গী যশপালকে। তিনিও একই দাবি করেন। আরও অনেকেই এমন মতে সমর্থন জানান।
কিন্তু সত্যিই কি গান্ধীর চেষ্টা যথেষ্ট ছিল না? ইতিহাস বলছে, ১৯৩০ সালের ৪ মে ভগৎ সম্পর্কে ভাইসরয়কে প্রথম চিঠি লেখেন গান্ধী। সেখানে তিনি সাফ জানান, যেভাবে আইনি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে শর্ট কাট বের করা হয়েছে তাকে ‘লুকনো মার্শাল ল’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এখানেই শেষ নয়। যত সময় এগিয়েছে, ততই গান্ধী তাঁর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি এলাহাবাদে এক জনসভায় তিনি জানিয়েছিলেন, ফাঁসা তো নয়ই। ভগৎ সিংকে জেলবন্দি করে রাখাই অযৌক্তিক।
[আরও পড়ুন: সন্ত্রাসবাদের নয়া ব্যাখ্যা কেন্দ্রের, ধরা পড়লে যাবজ্জীবন-ন্যূনতম ১০ লাখ জরিমানা, মিলবে না প্যারোলও]
পরের মাসে ১৮ ফেব্রুয়ারি ভাইসরয় লর্ড আরউইনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল গান্ধীর। তিনি ভাইসরয়কে বলেন, যদি আরউইন চান গোটা দেশের পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে থাকুক, তাহলে তাঁর উচিত ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি রদ করা। এই সাক্ষাতের উল্লেখ আরউইন তাঁর সেক্রেটারি অফ স্টেটের রিপোর্টেও করেছিলেন।
সময় যত এগিয়েছে ততই সক্রিয় হয়েছেন গান্ধী। ১৯৩১ সালের ২০ মার্চ তিনি দেখা করেছিলেন হোম সেক্রেটারি হারবার্ট এমার্সনের সঙ্গে। সেই সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ না হওয়ায় পরের দিন ফের দেখা করেন আরউইনের সঙ্গে। শোনা যায়, ২২ মার্চ নাকি ভাইসরয় আশ্বাসও দেন গান্ধীকে। কিন্তু সব আশ্বাসই ছিল মিথ্যে। পরদিনই ফাঁসি হয়ে যায় ভগৎ সিংয়ের। যদিও সেদিনই গান্ধী একটি শেষ চেষ্টা করেছিলেন আরউইনকে চিঠি লিখে। মরিয়া চেষ্টা বলাই যায়। সেখানে তাঁর আরজি ছিল, ‘মৃত্যুদণ্ড এক অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ। আপনার যদি মনে হয় এই রায়ের ক্ষেত্রে ত্রুটির ন্যূনতম সম্ভাবনাও রয়েছে, তাহলে আমি আপনাকে অনুরোধ করব পরবর্তী পর্যালোচনার জন্য এটাকে রদ করতে।’ কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় যোগদান করতে যাওয়ার আগে রাতে করাচির উদ্দেশে ট্রেন ধরতে যাওয়ার ঠিক আগে এই চিঠি লিখেছিলেন মহাত্মা। তিনি যখন ট্রেনে, তখনই ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। কিন্তু ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরও গান্ধীকে ব্রিটিশ সরকারকে এই মৃত্যুদণ্ডের জন্য কাঠগড়ায় তুলতে দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু এরপরও ‘গান্ধী যথেষ্ট চেষ্টা করেননি’ এই দাবিটি রয়েই গিয়েছে। এত বছর পেরিয়ে এসেও যা নিয়ে চর্চা অব্যাহত। কিন্তু গান্ধীর সমালোচকরা একটা জায়গায় এসে ভুল করেন। তাঁদের বোঝা উচিত, সত্যিই শেষ পর্যন্ত ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি না হলে তাতে গান্ধীর জনপ্রিয়তাও বাড়ত। শুধু তাই নয়, অহিংসার পথে চলা গান্ধী যদি সশস্ত্র বিপ্লবের পথে চলা ভগতের ফাঁসি রদ করাতে পারতেন তাহলে তাঁর পথ ও মতই মহিমান্বিত হত আরও বেশি করে। গান্ধী নিজেও জানতেন, ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি আটকাতে না পারলে তাঁর সমালোচকরা হাতে একটা বিরাট অস্ত্র পেয়ে যাবেন। এরপরও তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করবেন না? আসলে গান্ধী ও ভগতের দুই ভিন্ন পথের কারণেই হয়তো এমন একটা ধারণা করেন অনেকে। কিন্তু ইতিহাসের নথি অন্য কথাই বলে। দিনের শেষে অতীতকে দেখতে এর চেয়ে বড় ‘দূরবীন’ আর কী আছে?