অভিরূপ দাস: বন্ধুর হাতে DSLR। তাঁকে বগলদাবা করে যে তরুণী তাঁর পরনে একটা ঢাকাই জামদানি। সঙ্গের প্লাস্টিকে আরও দুটো লালপাড় হ্যান্ডলুম শাড়ি। লক্ষ্য একটাই। নানা সাজে নিত্য নতুন পোজ দিয়ে মা দুর্গার সঙ্গে খান দেড়শো ছবি। সে সব ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে দিলেই কয়েক হাজার লাইক পাকা। উঠতি মডেল-ফটোগ্রাফারদের ঠেলায় কাজকর্ম লাটে উঠেছে মৃৎশিল্পীদের।
এক মনে ঠাকুরের নাক আকারে আনছিলেন শিল্পী শিবানী পাল। দুম করে ঢুকে পড়ে যুগল। ‘‘এক্সকিউজ মি। আমরা একটু ঠাকুরের সঙ্গে ক্লোজ ছবি তুলব।’’ আবদারে প্রাণ অতিষ্ঠ হওয়ার জোগাড়। প্রশান্ত পাল বলছেন, একদিকে তো ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি থামলে উঠতি মডেলদের অত্যাচার। কাজ করব, না ফোটোগ্রাফারদের আবদার শুনব।
সোশাল মিডিয়ায় ছবি দেওয়ার নেশায় উঠতি মডেল-ফোটোগ্রাফারদের ভিড়ে এখন নাভিশ্বাস কুমারটুলির। কুমোরপাড়ায় কান পাতলেই ক্যামেরার শাটারের আওয়াজ। স্লিভলেস ব্লাউজে কপালে ত্রিনয়ন এঁকে একের পর এক পোজ দিয়ে চলেছেন ললনারা। মাঝে মধ্যে ঠাকুরের সামনেই সিগারেট টানছেন। মৃৎশিল্পীদের অনুযোগ, অবস্থা এমনই, পারলে কেউ মা দুর্গার কোলে উঠে পড়েন। ভক্তিশ্রদ্ধা জলাঞ্জলি দিয়েছে। চুলোয় যাক ঠাকুর। এদের কাছে ছবি তোলাটাই মুখ্য।
[আরও পড়ুন: পুজোর ছুটিতে পাহাড় টানে দক্ষিণকে, উত্তরের মানুষ কোথায় যেতে ভালোবাসেন?]
অভিযোগ, লাইক পাওয়ার আবেগে কেউ দুর্গার কাঁধে হাত দিচ্ছেন, কেউ আবার অশালীন কায়দায় শাড়ি পরে দুর্গাকে পশ্চাদ্দেশ দেখাচ্ছেন। বিরক্ত কুমোররা আপাতত এঁদের থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার রাস্তা খুঁজছেন। অগামী ১৪ অক্টোবর মহালয়া। ওইদিন কুমোরটুলিতে এসে শাড়ি পরে সেজেগুজে ছবি দিলেই গুচ্ছ গুচ্ছ লাইক। এখন থেকেই ভিড়ের বহর অনুমান করে প্রমাদ গুনছেন মৃৎশিল্পীরা। শিল্পী সৌমেন পালের কথায়, ‘‘আগে ছিল উঠতি মডেল। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্লগার। কেউ কেউ নিজেরাই দুর্গা সেজে ত্রিশূল কিনে চলে আসছে। ঠাকুরের সামনে অঙ্গভঙ্গি করে নাচ গান করছে। বিষয়টা দিন-কে-দিন সহ্যের অতীত হয়ে যাচ্ছে।’’
তিন তিনটে সংগঠন রয়েছে কুমোরটুলিতে। কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সাংস্কৃতিক সমিতি, কুমোরটুলি প্রগতিশীল মৃৎশিল্প সাজশিল্প সমিতি, আর একটা কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সমিতি। তিন সমিতিই মডেল-ফোটোগ্রাফারদের অত্যাচারে নাজেহাল।তিন সমিতির পক্ষ থেকে সম্প্রতি এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জানানো হয়েছে, শ্যামপুকুর থানায়। মৃৎশিল্প সাংস্কৃতিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জিত সরকার জানিয়েছেন, থানাকে আমরা জানিয়েছি, দয়া করে এদের একটু নিয়ন্ত্রণ করুন। কিন্তু পুলিশ আধিকারিকদের সাফ জবাব, কোন আইনে এমন শখের মডেল-ফোটোগ্রাফারদের নিয়ন্ত্রণ করব।
শখের ফোটোগ্রাফারদের নিয়ন্ত্রণ করতে প্রণামী চালু করেছিল কুমারটুলি। পুজোর একদিন ছবি-ভিডিও তুলতে গেলে দিতে হবে পঞ্চাশ টাকা। সারা বছরের ছবি তোলার পাসের মূল্য একশো টাকা। কিন্তু তাতেও ঠেকানো যাচ্ছে না হুড়োহুড়ি। অভিযোগ, ঠাকুরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছবি তোলার অতি উৎসাহে কেউ দুর্গার আঙুল ভেঙে ফেলছেন। কেউ খুবলে নিচ্ছেন অসুরের কান। ঠাকুর তৈরি করতে করতে তাই মায়ের কাছেই প্রার্থনা করছেন কুমোররা, ‘‘ব্লগার, মডেল, ফোটোগ্রাফাদের ঠেকাতে তুমিই একটা ব্যবস্থা করো মা।’’