স্টাফ রিপোর্টার: চেয়ার-বেঞ্চ-ব্ল্যাকবোর্ড সবই আছে। নেই কোনও কোলাহল। শুনশান স্কুল চত্বর। বাইরের দেওয়াল জুড়ে যামিনী রায়ের ছবি এঁকে চলেছে কলকাতার (Kolkata) তিন ছাত্র। তিনজনই দিনমজুর পরিবারের। প্রধানশিক্ষক রং তুলির ব্যবস্থা করেছেন। তিনজোড়া নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সেজে উঠছে স্কুলের দেওয়াল ক্যানভাস। ভোল বদলে যাচ্ছে যাদবপুর নবকৃষ্ণপাল শিক্ষায়তনের। দুঃস্থ তিন মেধাবী পড়ুয়ার কথায়, “ভোট মিটলে হয়তো স্কুল পুরোপুরি খুলে যাবে। টানা এক বছর পর যারা আসবে তাদের উদ্দেশে হেড স্যারের দেওয়া রং-তুলি কাজে লাগাচ্ছি।”
বাপন সর্দার, সৌম্য গুছাইত এবং নবারুণ ঘোষ। প্রথমজনের বাবা যাদবপুর স্টেশনের কাছে রিকশা চালান। দ্বিতীয় ছাত্রর বাবা মোটর মেকানিক। তৃতীয় পড়ুয়ার সংসার চলে মায়ের সেলাই থেকে। পরিবারের অনটন তাদের মেধাকে আটকে রাখতে পারেনি। একজন সদ্য প্রাক্তনী। বাকি দু’জন নবকৃষ্ণ পাল স্কুলের ছাত্র। প্রধান শিক্ষক শ্যামলকুমার মিশ্রর নিরন্তর উৎসাহে ছবি এঁকে চলে তারা। কিশোর শিল্পীদের সৃষ্টি ইউরোপের প্রদর্শনী থেকে সম্প্রতি প্রশংসা ছিনিয়ে এনেছে। তিনজনই হতদরিদ্র পরিবারের। শুধু ছবি আঁকাই নয়, পড়াশোনাতেও বেশ উজ্জ্বল। সৌম্য এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বাপন গত বছর উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে দিলেও স্কুলের সঙ্গে তার নিরন্তর যোগাযোগ।
[আরও পড়ুন: মেট্রো ডেয়ারি মামলায় আরও সক্রিয় ইডি, নোটিস পাঠিয়ে তলব রাজ্যের আরেক আমলাকে]
নবারুণ পড়ে একাদশ শ্রেণিতে। মহানগরের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে ছবি পাঠায় তারা। পুরস্কারের টাকা থেকেও মেলে রং—তুলির টাকা। প্রধানশিক্ষক ছাড়াও স্কুলের অন্য শিক্ষকরাও সাহায্য করেন। দুচোখভরা স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যায় তিন পড়ুয়া। গত বছর কলকাতার সেন্ট লরেন্স স্কুলে একটি অঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়। নারী নির্যাতন বিষয়ে সৌম্যর ছবি নজরে আসে জুরিদের। সেই ছবি পৌঁছে যায় আয়ারল্যান্ডে। ইউরোপের চিত্রকররাও প্রশংসা করেন সেই ছবির।
করোনা সতর্কতায় গত বছর মার্চ মাসে রাজ্যের সব স্কুলে পঠনপাঠন বন্ধ হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নবম থেকে দ্বাদশের ক্লাস শুরু হলেও বাকি ক্লাসগুলি চালু হয়নি। এই তিন ছাত্র যোগাযোগ রেখেছিল স্কুলের সঙ্গে। প্রধান শিক্ষক শ্যামলবাবু জানিয়েছেন, “এনআরআই বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে অভাবী পরিবারগুলিকে কিছুটা সাহায্য করতে পেরেছি। লকডাউনে ওদের আঁকা যাতে থেমে না থাকে সেই চেষ্টাও করেছি। বন্ধ স্কুল পুরোপুরি খুললে সবার ভাললাগার কথা ভেবে বাইরের দেওয়ালে ছবি আঁকার প্রস্তাব দিই। তিনজন তা লুফে নেয়। এখন যামিনী রায়ের ছবি আঁকা চলছে। এরপর রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠ এবং সুকুমার রায়ের হযবরল থিম করে ছবি আঁকা হবে।” মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়াদের মক টেস্ট চলছে নবকৃষ্ণ পাল স্কুলে। পরীক্ষা হয়ে গেলে ফের শুরু হবে আঁকার কাজ। গোটা পরিকল্পনা কার্যকর হলে এই স্কুল গোটা শহরে নজির তৈরি করবে বলে মনে করেন শিক্ষকরা। কিছুই চায় না বাপন—সৌম্য—নবারুণ। তাদের একমাত্র কামনা, অভাব যেন কোনওভাবে শিল্পীসত্তাকে হারাতে না পারে।