স্টাফ রিপোর্টার: রাজ্য বিজেপির কোন্দল জোড়াতালি দিয়ে আজ, শনিবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পূর্বাঞ্চলীয় পরিষদের বৈঠকটি অনেকদিন আগেই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু, শাহর সফরের আগেই রাজ্য বিজেপির কোন্দল তীব্র জায়গায় পৌঁছয়। প্রকাশ্যে শুভেন্দু অধিকারী ও দিলীপ ঘোষের লড়াই অস্বস্তিতে ফেলে দলকে। সে কারণে শুক্রবার রাতে সরকারি সফরে কলকাতায় পৌঁছেই শাহকে রাজ্য বিজেপি নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসতে হয়। মধ্য কলকাতার মুরলীধর সেন লেনে বিজেপির রাজ্য দপ্তরে জরুরি ভিত্তিতে ডাকা বৈঠকের পর শাহ গভীর রাত পর্যন্ত আলাদা আলাদা করে নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন বাইপাসের ধারে একটি হোটেলে।
গভীর রাত পর্যন্ত দলীয় কোন্দল জোড়াতালি দিয়ে সামলানোর পর শনিবার বেলা ১১টায় শাহ যাবেন নবান্নে। দুপুর ১টা পর্যন্ত বৈঠক চলবে। এরপর আধঘণ্টা রিজার্ভ রাখা হয়েছে। ওই সময় শাহ মমতার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করতে পারেন বলেও জল্পনা রয়েছে। আজকের বৈঠকে থাকার কথা ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক, বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনেরও। বৈঠকে আন্তঃরাজ্য সীমান্ত সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা নিয়েই আলোচনা হবে। নিরাপত্তা, চোরাচালান, পরিবহণ, বিদ্যুৎ-সবই রয়েছে তালিকায়। জানা গিয়েছে, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তালিকা স্ক্রুটিনি করে চূড়ান্ত করেছে পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটি। সেই মতোই আলোচনা হবে।
[আরও পড়ুন: ‘প্রয়োজনে শিক্ষামন্ত্রীকে তলব করব’, নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় হুঁশিয়ারি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের]
শুক্রবার রাতে বিজেপির রাজ্য দপ্তরের বৈঠকে শাহর তোপের মুখে পড়েন নেতারা। বেশ কয়েকদিন ধরেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ও দলের প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ নিয়ম করে একে অপরের বিরুদ্ধে বিবৃতি-পালটা বিবৃতি দিচ্ছেন। দলের এমন পরিস্থিতি তাঁর কাছে যে যথেষ্ট অস্বস্তিকর সেই বার্তা দিয়ে সফরের আগেই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বি এল সন্তোষকে বাংলায় পাঠিয়েছেন। শাহ চাইছেন পঞ্চায়েত ভোটের আগে অন্তত জোড়াতালি দিয়ে বিবাদে দীর্ণ বঙ্গ বিজেপির ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে।
বিমানবন্দর থেকেই শাহ নিজের গাড়িতে তুলে নেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও শুভেন্দুকে। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে মুরলীধর সেন লেনে পৌঁছতে শাহর প্রায় ৪৫ মিনিট লাগে। গাড়িতেই শুভেন্দু-সুকান্তর সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনা সেরে নেন। পরে রাজ্য দপ্তরে নেতাদের সামনে বেশ কড়া মেজাজে তাঁকে দেখা যায়। পার্টি অফিসের নিচে মিডিয়া রুমেই বৈঠকে বসেন তিনি। পর্যবেক্ষক সুনীল বনশল, অমিত মালব্য, মঙ্গল পাণ্ডে, আশা লকরা-সহ ১৮ জন বৈঠকে ডাক পান। ছিলেন নিশীথ প্রামাণিক, সুভাষ সরকার, সতীশ ধন্দ, অমিতাভ চক্রবর্তী, দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী, লকেট চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো, খগেন মুর্মু, স্বপন দাশগুপ্ত, জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল, দীপক বর্মন।
তবে শাহ আসার আগেই তাল কাটে। অনেক পুরনো বিজেপির নেতাকে মুরলীধর সেন লেনের গলির ভিতর যাওয়ার জন্য কার্ড ইস্যু করা হয়নি। এই নিয়ে ক্ষোভ চরমে ওঠে। বৈঠকের পর ‘সেভ বিজেপি বেঙ্গল’-এর পক্ষ থেকে একটি টুইটও করা হয়। তাতে বলা হয়, রাজ্য সংগঠনের প্রকৃত অবস্থা জানতে শাহর উচিত জেলা সভাপতিদের সঙ্গে বৈঠক করা। শাহ যে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা মনগড়া রিপোর্ট দিয়েছেন। বৈঠক সেরে ১০টা নাগাদ রাজ্য দপ্তর থেকে বেরোন শাহ। বৈঠক নিয়ে দিলীপ জানান, এদিন সকালে বিজেপির কার্যকারিণী বৈঠকের নির্যাস সম্বন্ধে শাহকে অবহিত করেন বিজেপির অন্যতম কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডে। সেটা শোনার পর শাহ বলতে শুরু করেন। তিনি রাজ্য নেতৃত্বকে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বুথস্তর পর্যন্ত পৌঁছনোর পরামর্শ দিয়েছেন। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করার পরামর্শ দিয়েছেন শাহ। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে শক্তি বাড়ানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের কথা বলেছেন। দলের নিচুতলার কর্মীদের কাছে পৌঁছতে হবে-এই নির্দেশও দেন শাহ। বলেন, পুরনো নেতা-কর্মীদের কাছে টানুন।
তারিখ বিতর্ক নিয়ে শাহ কিছু বলেছেন কি না জানতে চাওয়া হলে দিলীপ কিছুটা শুভেন্দুর দিকে ইঙ্গিত করে শ্লেষপূর্ণভাবে বলেন, ‘‘অমিত শাহ অতীতে কখনও মুরলীধর সেনের রাজ্য দপ্তরে আসেননি। ডিসেম্বর মাসেই তিনি এলেন। ডিসেম্বরে কী হয়, সেটাই দেখার ছিল।’’ রাজ্য দপ্তরে বৈঠকের পর শাহ শুভেন্দু ও সুকান্তকে গাড়িতে নিয়ে হোটেলে চলে যান। রাতে হোটেলেও কয়েক দফা বৈঠক হয়। সূত্রের খবর, রাতের সেই বৈঠকে বঙ্গ বিজেপির ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও কোন্দল নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুকান্তদের বলেন তিনি। মিলেমিশে সকলকে নিয়ে চলার কথা বলেন। শুভেন্দুকে সাফ বলে দেন, দিল্লির নির্ভরতা ছাড়তে হবে। রাজনৈতিক আন্দোলন করেই রাজ্যে বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে।
শাহ আসার আগেই হুগলিতে রাজ্য বিজেপির বিশেষ সাংগঠনিক বৈঠকেও দলের কোন্দল নিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন বি এল সন্তোষ। সন্তোষ বলেছেন, ‘‘নিয়ম মেনে রাজনীতি করুন। একত্রে কাজ করতে হবে। পুরনোদের সব বাদ দিয়ে নতুনদের বুথ সভাপতি করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।’’ প্রাক্তন জেলা সভাপতিদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখার জন্য রাজ্য নেতাদের নির্দেশ দেন তিনি। জানিয়ে দেন, বিজেপি পার্টির সংস্কৃতি হচ্ছে পুরনোদের সম্মান করা। রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত ও অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়দের নিয়মিত বৈঠক ও কর্মসূচিতে ডাকা হচ্ছে না কেন, তাও এদিন সন্তোষ জানতে চান। রাজ্য নেতৃত্বকে কেন্দ্রীয় নেতার পরামর্শ, সমঝোতা করবেন না। কারও কাছে বিক্রি হয়ে যাবেন না। অন্যদিকে, রাজ্যে দলের সংগঠনের হাল যে তলানিতে তা এদিন স্পষ্ট হয়েছে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের ভাষণেও। সুকান্ত বলেছেন, ‘‘এখানে সংগঠনের মাধ্যমেই রাজনীতি করতে হবে।’’
এদিকে, শনিবার নবান্নে পূর্বাঞ্চলীয় পরিষদের বৈঠকে আর্ন্তজাতিক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। জমি অধিগ্রহণের কাজ মার্চের মধ্যেই শেষ করতে হবে। জানা গিয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ হচ্ছে। ২৫৭ কিমি জুড়ে আর্ন্তজাতিক সীমান্তে ১৮৬ কিমি কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জমি মিললেও ৭০ কিলোমিটারের কাজে এগোচ্ছে না। রাজ্যকে এই জমি অধিগ্রহণ করে দিতে হবে। নবান্ন সূত্রের খবর, সীমান্তে চোরাচালান, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি রুখতে বিএসএফের ভূমিকা নিয়েও মত বিনিময় হবে। বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিএসএফ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা। রাজ্যের আন্তর্জাতিক সীমান্তে নিরাপত্তা নিয়েই এই বৈঠক। বিএসএফের টহলদারি এলাকা ১৫ কিমি থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হয়েছে। এই বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। ঝাড়খণ্ড সীমান্তে মাওবাদী কার্যকলাপ মাথাচাড়া দেওয়ায় জঙ্গলমহলে পুনরায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের অনুরোধও জানানো হতে পারে।