shono
Advertisement
ISI

‘ব্রিটিশ ঘেঁষা’ বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলনের অংশ মহলানবিশ! আইএসআইকে অমর্যাদার কারণ নিয়ে প্রকাশ্যে বিস্ফোরক তথ্য

খসড়া আইএসআই বিলের জন্য জনমত চেয়েছে শিক্ষামন্ত্রক।
Published By: Sayani SenPosted: 11:16 PM Dec 17, 2025Updated: 11:17 PM Dec 17, 2025

ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: অবশেষে সামনে এল কীসের জ্বালায় আইএসআইয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে চাইছে কেন্দ্র সরকার। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা পরিষদের সদস‌্য এবং ইতিহাসের ‘সংশোধনবাদী হিন্দুত্ব’ নিয়ে নানা বইয়ের লেখক সঞ্জীব সান‌্যালের একটি ইংরেজি ইন্টারভিউ সদ‌্য প্রকাশ্যে এসেছে। যেখানে এই সরকারি আমলা বারবার আইএসআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বখ‌্যাত পরিসংখ‌্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে ‘মহলানবিশ’, ‘দিস গাই’ বলে সম্বোধন করছেন এবং যাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বলছেন, ‘তিনি আসলে ব্রিটিশদের গা ঘেঁষা হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।

Advertisement

নিজের পরিচিতি বানাতে গিয়ে বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছিলেন। আর এ দেশের মানুষের সঙ্গে আর্যদের মিল খুঁজে বের করতে গিয়ে পরিসংখ‌্যানের নাম দিয়ে মানুষের নাক-খুলির মাপজোক করা শুরু করেছিলেন।’ শুধু এইটুকুকেই তাঁর ‘ব‌্যাকগ্রাউন্ড’ বলেও উল্লেখ করেন সেই সান‌্যাল। আরও জানা দরকার, এই সান‌্যাল সেই প্ল‌্যানিং কমিশনের সদস‌্য, এক সময় যার সদস‌্য ছিলেন খোদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।

বাংলার রেনেসাঁর অন‌্যতম পুরোধা মহলানবিশ সম্পর্কে এমন ‘আদর্শ’ মূল‌্যায়নকেই আইএসআইয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে তাকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে বেঁধে ফেলার মূল ভাবনা বলে মনে করছে রাজ্যের বিদগ্ধমহল। কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব আর রাজধানীতে বসে থাকা তাদের ধামাধরা আমলাতন্ত্রের সেই পুরনো রোগ–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ‌্যায়ের মতো একইভাবে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের মতো বাঙালি মনীষীদের মর্যাদাহানি করা, বাংলার গৌরবের মুকুটকে ধুলোয় লোটানোর ব‌্যর্থ চেষ্টা। বুধবার ১৭ ডিসেম্বর আইএসআইয়ের ৯৫ তম প্রতিষ্ঠা দিবসে দাঁড়িয়ে বাঙালি-বিদ্বেষের সেই সংস্কৃতি আবারও প্রকাশ্যে এনে দিল আইএসআইয়ের প্রাক্তনী, বিশ্বখ‌্যাত অধ‌্যাপকদের মিলিত প্রতিবাদ।

দু’দফায় এই দিনটি স্মরণ করা হয়, যার মূল অনুষ্ঠানটি করে সেখানকার অধ‌্যাপক-অশিক্ষক কর্মচারীদের সংগঠন ইন্ডিয়ান স্ট‌্যাটিসটিক‌্যাল ইনস্টিটিউট ওয়ার্কারস অরগানাইজেশন বা আইএসআইডব্লুও। যোগ দিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ছাত্র অধ‌্যাপক পার্থপ্রতীম মজুমদার, অধ‌্যাপক অমর্ত‌্যকুমার দত্ত। অধ‌্যাপক মজুমদারই কেন্দ্রীয় সরকারের আমলা সঞ্জীব সান‌্যালের সেই ইন্টারভিউটি সামনে আনেন। সঙ্গে মূল যে উদ্দেশ্যে তাঁর অধ‌্যাপক মানুষের বর্ণ-জাতি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলেন এবং যার মাধ‌্যমে পরিসংখ‌্যান তত্ত্বের আবিষ্কার, তারও ব‌্যাখ‌্যা দেন।

এর মধ্যেই খবর, খসড়া আইএসআই বিলের জন‌্য যে জনমত চেয়েছিল শিক্ষামন্ত্রক, তার মেয়াদ আরেক দফায় ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আইন বদলে যেভাবে আইএসআইকে কেন্দ্র সরকার নিজেদের কব্জায় আনতে চাইছে, তার বিরোধিতা করে এদিনও ক‌্যাম্পাসে মানববন্ধন করে মৌন প্রতিবাদ হয়েছে। আইএসআইডব্লুও-র দাবি, দেশের আইআইটিগুলো যে নিয়মের বেড়ায় চলে, সেই উদ্দেশ্যে আইএসআই তৈরি হয়নি। তাই এই আইন প্রত‌্যাহার হোক। স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র বিজ্ঞান সাধনার একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কবিগুরুর বিশ্বভারতীকে আদর্শ করেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। যেভাবে রবীন্দ্রনাথের হাতে বিশ্বভারতী তৈরি হয়েও স্বতন্ত্র পরিচয় পেয়েছিল, আইএসআইয়েরও আদর্শ তাই। বিশ্বভারতীয় সংবিধান লিখে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার প্রথম যুগ্ম সচিব হিসাবে বিশ্বভারতীর দায়িত্ব সামলানো মহলানবিশ পরে আইএসআই তৈরির সময় চেয়েছিলেন আজীবন বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য়ের আদর্শকে পাথেয় করে চলবে তাঁর প্রতিষ্ঠান। চিরকাল যা নিজের স্বতন্ত্র বজায় রাখবে। অভিযোগ, সেই আদর্শের মূলে কুঠারাঘাত করে বাংলার রেনেসঁার সঙ্গী শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো এক প্রতিষ্ঠানকে ধাক্কা দিতে চাইছে বিজেপি সরকার। আইএসআইডব্লুও-র তরফে এদিন ছিলেন পার্থ মোহান্ত, অরিজিৎ বিষ্ণু, কুন্তল ঘোষ-সহ সংগঠনের অধ‌্যাপক-অশিক্ষক কর্মচারীদের প্রত্যেকে।

অধ‌্যাপক পার্থপ্রতীম মজুমদার তথ‌্য দিয়ে জানান, একটি সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৩৭ নাগাদ উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ডের বাসিন্দা এবং জনজাতিদের মধ্যে ভিন্নতা বোঝার কাজ শুরু করেন মহলানবিশ। তারই ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, মুসলিম-সহ একাধিক প্রজাতির মানুষকে সম্প্রদায়, বাসস্থান, অভ‌্যাস, শারীরিক গড়নের ভিন্নতায় পরিমাপ করেন। সেই থেকেই পরিসংখ‌্যান তত্ত্বের পথ চলা শুরু। ওই দুই প্রদেশের ভিত্তিতে ড. মহলানবিশের পর্যবেক্ষণ, সেখানকার ব্রাহ্মণ আর সমাজের উচ্চবর্ণের মধ্য়ে খুব কম তফাৎ ছিল। পরে বাংলার ক্ষেত্রেও একইভাবে মাপজোক হয়। পাওয়া যায় যে, উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণের বঙ্গের ব্রাহ্মণের সংজ্ঞা আলাদা। অধ‌্যাপক মহলানবিশের বক্তব‌্য ছিল বাংলায়, ‘গোষ্ঠী, জাতি, ধর্ম বা উপজাতি নির্বিশেষে একই জেলায় বসবাস করে’। অর্থ‌াৎ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যদিও জাতিভেদ নিয়ে ড. মহলানবিশের পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘আমরা জাতিদের যেভাবে ভেদাভেদ করে থাকি, শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠিতে সেটা আদৌ সমর্থনযোগ‌্য নয়।’ এইসব তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবেই যে কেন্দ্রীয় বিজেপির আদর্শের পরিপন্থী এবং সেই জ্বালা থেকেই বাংলা-বিদ্বেষ, তা স্পষ্ট।

১৯৫৯-এ আইএসআইয়ের জন‌্য যে আইন তৈরি করেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, অধ‌্যাপক অমর্ত‌্যকুমার দত্ত এদিন লোকসভায় তাঁর সেই বক্তৃতা তুলে ধরেন। নেহরু এর স্বাতন্ত্র‌্য রক্ষার জন‌্য সওয়াল করে বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞান সাধনায় নিযুক্ত কোনও প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না। আর আইএসআইকে সরাসরি কোনওদিন কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানেও পরিণত করা যাবে না।’ পরে আইএসআই-এর তরফে এদিন দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে ভারতীয় ইকোনোমেট্রিক সোসাইটির পক্ষ থেকে অধ্যাপক প্রণব বর্ধনকে অধ্যাপক সি. আর. রাও শতবর্ষ স্মারক স্বর্ণপদকে সম্মানিত করা হয়। তাত্ত্বিক অর্থনীতি, উন্নয়নমূলক অর্থনীতি এবং প্রয়োগমূলক গবেষণায় তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতির জন‌্য এই সম্মান তাঁকে দেওয়া হয়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ‘ব্রিটিশ ঘেঁষা’ বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলনের অংশ মহলানবিশ!
  • কেন্দ্রীয় আমলার মূল্যায়নই আইএসআইকে অমর্যাদার কারণ, প্রকাশ্যে বিস্ফোরক তথ্য।
  • খসড়া আইএসআই বিলের জন্য জনমত চেয়েছে শিক্ষামন্ত্রক।
Advertisement