সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: তাঁর নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দল সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার কাছে শেষ চারের লড়াইয়ে হেরে যাওয়ায় সেবার আর ফাইনালের ছাড়পত্র পায়নি ভারত। ফুটবলার ও কোচ হিসেবে সন্তোষ ট্রফি জয়ের কৃতিত্ব ছিল তাঁর। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর চিরবিদায় নিলেন সেই সমর বন্দ্যোপাধ্যায় (Samar Banerjee)। কলকাতা ময়দান তাঁকে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় হিসেবেই চেনে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। শুক্রবার রাত ২.১০ মিনিট নাগাদ এসএসকেএম হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি ফুটবলার। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় বেশ কয়েকদিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। অ্যালঝাইমার্সও ছিল। রেখে গেলেন নাতনি এবং পুত্রবধূকে। তাঁর প্রয়াণে শোকের ছায়া ফুটবল জগতে।
১৯৩০ সালের ৩০ জানুয়ারি হাওড়ার বালিতে বিখ্যাত ব্যানার্জি পরিবারে জন্ম বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাড়িতে ফুটবলের একটা পরিবেশ ছিলই। পরিবারের প্রায় সকলেই ছিলেন ফুটবল অনুরাগী। প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই বাড়ির বারান্দায় ফুটবল নিয়ে আলোচনা হত। ছোট্ট বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় সেই গল্প শুনতেন ছোটবেলা থেকেই। তাঁর বাবা খুব কড়া মানুষ ছিলেন। পড়াশোনায় অবহেলা করার জন্য বকাবকি করতেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু বাবার বকুনি সত্ত্বেও ছোট্ট বদ্রু সেই আলোচনা শুনতেন। আলোচনায় কলকাতার তিন প্রধান-ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহামেডান স্পোর্টিংয়ের প্রসঙ্গ উঠত। কলকাতা ময়দানের অন্য ক্লাবের কথাও উঠত আলোচনায়। বলতে গেলে সেগুলো গোগ্রাসে গিলতেন বদ্রু।
[আরও পড়ুন: মথুরার মন্দিরে মঙ্গল আরতিতে উপচে পড়া ভিড়, শ্বাসকষ্টে প্রাণ হারালেন ২ ভক্ত]
বদ্রুর দাদা রাধানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন খ্যাতিমান ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু অল্পবয়সেই তিনি মারা যান। খেলার মধ্যেই আহত হয়ে তিনি মারা যান। দাদার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। দাদার স্মৃতি আঁকড়ে বড় ফুটবলার হওয়ার শপথ নেন তিনি। খেলায় তাঁকে উৎসাহ দিতেন নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, ল্যাংচা মিত্রের মতো ব্যক্তিত্ব।
মিলন সমিতি ক্লাবে অভিষেক হয় বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরে বালি প্রতিভা ক্লাবে যোগ দেন তিনি। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটবল চালাচ্ছিলেন বদ্রু। যোগ দেন বিএনআর-এ। কলকাতা লিগে বিএনআরের হয়ে বেশ ভাল খেলেন তিনি। তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হন মোহনবাগান (Mohun Bagan) কর্তারা। ১৯৫২ সালে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়কে সই করান হয় সবুজ-মেরুনে। আট মরসুম মোহনবাগানের হয়ে খেলেন তিনি। মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরিবার পড়াশোনার উপরে জোর দিতেন। সেই সময়ে পড়াশোনা ও ফুটবল দুটোই একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। এভাবে কিছু দিন চলার পরে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেছে নিতে হয় একটা। তিনি ফুটবলকেই বেছে নেন।
মোহনবাগানের হয়ে অভিষেক মরশুমে রাজস্থান ক্লাবের সঙ্গে যুগ্মভাবে আইএফএ শিল্ড জেতেন বদ্রু। প্রথম ম্যাচটা গোলশূন্য ভাবে শেষ হয়েছিল। রিপ্লে ম্যাচের ফলাফল হয়েছিল ২-২। পরের বছর ১৯৫৩ সালে প্রথম ডুরান্ড কাপ জেতে মোহনবাগান। এই টুর্নামেন্টের নক আউট পর্বে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সেমিফাইনালে হায়দরাবাদ পুলশিকে ১-২ গোলে হারিয়েছিল মোহনবাগান। বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় জয়সূচক গোলটি করেছিলেন। ফাইনালে মোহনবাগান মুখোমুখি হয়েছিল ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির। মোহনবাগান ৪-০ গোলে হারিয়েছিল। ফাইনালে গোল করেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৪ সালে মোহনবাগান কলকাতা ফুটবল লিগ এবং আইএফএ শিল্ড জেতে। শিল্ড ফাইনালে হায়দরাবাদ পুলিশের বিরুদ্ধে গোল ছিল বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ফাইনালে তিনি নজর কেড়ে নেন। মোহনবাগানের হয়ে চতুর্থ মরশুমে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় একটি মাইলফলক তৈরি করেন। প্রথম বার রোভার্স কাপ জেতে মোহনবাগান। ফাইনালে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে গোল ছিল বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
১৯৫৬ সালে সাফল্যের শিখরে পৌঁছন এই দিকপাল ফুটবলার। জাতীয় দলের নেতৃত্ব পান তিনি। মেলবোর্ন অলিম্পিকে বদ্রুবাবুর নেতৃত্বেই ভারত খেলতে নেমেছিল। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ওয়াক ওভার পায় ভারত। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত ৪-২ গোলে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। সেমিফাইনালে অবশ্য রূপকথা থেমে যায় ভারতের। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে শেষ চারের লড়াইয়ে হার মানে ভারত। সেবারের অলিম্পিকে ভারত চতুর্থ হয়েছিল।
১৯৫৮ সালে মোহনবাগানের অধিনায়কত্ব পান তিনি। কিন্তু সেই বছর তিনটি প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ হয়েছিল সবুজ-মেরুন। কলকাতা ফুটবল লিগ ঘরে তুলতে পারেনি মোহনবাগান। শিল্ড ও রোভার্স ফাইনালেও হার মানে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন মোহনবাগান। ১৯৫৮–য় বার্মা শেলের চাকরিতে যোগ দেন তিনি। শিলিগুড়িতে ছিল পোস্টিং। সেখান থেকে এসে প্র্যাকটিস করা বা ম্যাচ খেলা সম্ভব হয়নি বেশিদিন। ১৯৫৯ সালে বুট জোড়া তুলে রাখেন বদ্রু। ফুটবল ছাড়ার পরে বরিষা এসসি ক্লাবকে কোচিং করান। কোচ হিসেবে বাংলাকে সন্তোষ ট্রফি এনে দেন তিনি। পরে নির্বাচক হিসেবেও কাজ করেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় ডাকবিভাগ বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মানে বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ করে। রাজ্য সরকারের তরফে পেয়েছেন জীবনকৃতি সম্মান। ২০০৯ সালে মোহনবাগান রত্ন সম্মানে ভূষিত হন। অর্জুন বা পদ্মশ্রী পুরস্কার পাননি।
মোহনবাগান শুধু একটা ফুটবল ক্লাব নয়, একটা প্রতিষ্ঠান। তাঁর কাছে মোহনবাগান ছিল মন্দিরের মতো। মোহনবাগানকে বুকে করেই চলে গেলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়।