বয়সকালে নানা কারণে হাড়ে ক্ষয় ধরতে পারে। এমন সমস্যা মেটাতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার অবদান কতটা? কোন উপসর্গে কী ওষুধ কার্যকর? সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানাচ্ছেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক শতরূপা চট্টোপাধ্যায়। শুনলেন মৌমিতা চক্রবর্তী।
হাড়ের ক্ষয়, বয়সকালের অন্যতম সমস্যা। সাধারণত পুরুষের তুলনায় মহিলাদের তাড়াতাড়ি হাড়ের ক্ষয় শুরু হয়। ক্যালশিয়ামের অভাব ছাড়াও দীর্ঘদিন অনিয়ম ও ভুল খাদ্যাভ্যাসের জন্য এমন হতে পারে। আর এ এক এমন সমস্যা যা শুরু হলে ব্যথা নিত্যসঙ্গী। হাড়ের ব্যথায় অনেক কারণ রয়েছে। তবে কারণ যাই হোক না কেন, প্রয়োজনে হোমিওপ্যাথি ওষুধে আস্থা রাখতে অনেকটাই কষ্ট কমানো সম্ভব।
আর্থ্রাইটিসে করণীয়: হাড় দুর্বল, হাড় ভাঙা, ব্যথা, জয়েন্ট নরম হয়ে যাওয়া, হাড় বিকৃত হয়ে ফুলে যাওয়া ইত্যাদি হাড়ের বিভিন্ন ধরনের অসুখ দেখা দেয়। যার মধ্যে অন্যতম আর্থ্রাইটিস। যা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিও আর্থ্রাইটিস এই দুই ধরনের হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশি আক্রান্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত পঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতে পারে। সাধারণত বংশগত কারণে এই আর্থ্রাইটিস হয়। হলে অস্থিসন্ধির স্ফীতি ও যন্ত্রণা হয়। এই অসুখের অসংখ্য প্রকারভেদ রয়েছে। অস্টিও আর্থ্রাইটিস সাধারণত বয়স্কদের হয় ও যে কোনও জয়েন্ট বিশেষত হাঁটু, কোমরকে আক্রান্ত করে। বয়স বাড়লে ওজন বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেশীও দুর্বল হয়। পারিবারিক সূত্রে কারও থাকলে প্রথম থেকেই সাবধান হওয়া উচিত। অস্থির প্রান্তে থাকা কার্টিলেজের ক্ষয় থেকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসের উৎপত্তি হয়। এবং দীর্ঘদিন আর্থ্রাইটিসে ভুগলে রোগীর প্যারালাইসিস হওয়াার সম্ভাবনাকে কমানোর জন্য ‘কস্টিকাম (Causticum)’ ওষুধ খুবই ভাল কাজ করে।
কবজি ও গোড়ালি ফুলে গিয়ে সুচ ফোটানোর মতো ব্যথা হলে অ্যাব্রোটেনাম ভালো কাজ দেয়। বিভিন্ন জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথার সঙ্গে স্পর্শ করলেও কষ্ট হলে আর্নিকা মন্টানা, রোগীর পূর্বে গনোরিয়ার সঙ্গে গাউট ও জয়েন্টে ব্যথার পাশাপাশি প্রস্রাবের রং বাদামি বর্ণের ঝাঁজালো হলে ‘বেনজোয়িক অ্যাসিড’ এবং পায়ের ব্যথা যদি নিচের থেকে উপরে ওঠে, রোগী ঠান্ডা সেঁক দিলে আরাম লাগে, তা হলে ‘লিডাম পল (Ledum Pal)’ ভীষণ উপকারী। ছোট ছোট জয়েন্টে অর্থাৎ হাত, পা, অস্থিসন্ধির প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট করলে ‘কলচিকাম (Colchicum)’, বিভিন্ন জয়েন্টে প্রদাহ যা থেকে ব্যথার স্থান গরম হয়ে যন্ত্রণা হলে ও গরম সেঁকেই আরাম পেলে ‘গুয়েকাম (Guaiacum)’ ভাল কাজ করে।
হাড়ের অন্যান্য ব্যথায় হোমিওপ্যাথি: হাড়ে আঘাত লেগে ভেঙে গেলে প্লাস্টার করার পরবর্তী ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা খুবই কার্যকরী। ফ্র্যাকচারের লক্ষণ ও কারণ ভিন্ন হলে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করলে ব্যথার উপশম হয়। সেক্ষেত্রে আর্নিকা, সিম্পফাইটাম (symphytum), হাইপেরিকাম (Hypericum), ক্যাল ফস (Cal phos) উল্লেখ্যযোগ্য। ক্যালেনডুলা (Calendula,) ওপেনও কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচারে ভীষণ উপকারী। ফ্র্যাকচার না হলেও বড় ধরনের আঘাতের পর ব্যথার ক্ষেত্রে ইউপাটৌরিয়াম পারফোলিয়াটাম (Eupatorium Perfoliatum), রুটা (Ruta), ব্রাইয়োনিয়া (Bryonia) ইত্যাদি ওষুধ ভাল ফল দেয়।
তাছাড়া আমাদের শরীরে প্রত্যেকটি জয়েন্টে সাইনোভিয়াল ফ্লুয়িড থাকে যা জয়েন্টের প্রত্যেকটি হাড়ের সঙ্গে হাড়কে ঘর্ষণ থেকে প্রতিরোধ করে। রোগের তারতম্য অনুযায়ী কিছু প্রদাহের কারণে এই ফ্লুয়িড বেড়ে বা কমে যেতে পারে। উভয়ক্ষেত্রেই যা হাড়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ফ্লুয়িড কমে গেলে লিডাম (ledum), রাস টক্স, বেনজোয়িক অ্যাসিডের (Benzoic Acid) দ্বারা ফ্লুয়িডকে বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় যাতে হাড়ের জয়েন্টে ঘর্ষণ কম হয়। একইভাবে ফ্লুয়িড বেড়ে গেলে সাইনভাইটিসের পর্যায়ে গিয়ে জয়েন্ট লাল হয়ে গরম ও ফুলে যায়। রোগীর নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়, প্রচণ্ড ব্যথা ও অস্বস্তি হয়। কনুই ও হাঁটু ফ্লুয়িডে ভরে যায়। কোনও পুরনো আঘাত, রিউমাটয়েড জ্বর, অত্যধিক ধূমপান এর জন্য দায়ী। রাসটক্স, ব্রায়োনিয়া, কসটিকাম (Causticum), প্যালস্যাটিলা (pulsatilla), ক্যালমিয়া (kalmia), সিমিফিউগা (Cimicifuga), কলচিকাম (Colchicum) প্রভৃতি ওষুধ খুব উপকারী। তবে প্রতিটি ওষুধই রোগীর বয়স ও রোগের লক্ষণ অনুযায়ী দেওয়া হয়। কার জন্য কী ওষুধ সেটা চিকিৎসকরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নিজে থেকে এ ওষুধ কখনই সেবন করা চলবে না। সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তারপর ওষুধ খান। হোমিওপ্যাথিতে হাড়ের ব্যথা নিরাময়ে অনেক প্রকার ওষুধ রয়েছে। সঠিক পরামর্শে তা কার্যকর।
সুস্থ থাকতে মানতে হবে: যে কোনও বয়সেই হাড় ভাল রাখতে ব্যালান্সড ডায়েট জরুরি। ছোট থেকেই শিশুর খাবারে পর্যাপ্ত ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিন ডি রাখতে হবে। বর্তমানে আমাদের জীবনশৈলীর পরিবর্তন হওয়ায় ছোটরা বাইরে রোদে খেলাধুলা করে না ও বড়রা কাজের ব্যস্ততায় গায়ে রোদ লাগাতে ভুলে গেছে। ফলে শরীরে ভিটামিন ডি-এর কমতি হচ্ছে। হাড়ের সুস্থতার জন্য ক্যালশিয়ামকে যদি প্রাধান্য দেওয়া হয় তবে ভিটামিন ডি ছাড়া তা অসম্পূর্ণ। সাপ্লিমেন্টরি ফুডের সঙ্গে দিনে ১০-১৫ মিনিট শরীরে সরাসরি রোদ লাগালে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয়, যা সুস্থ থাকতে খুবই জরুরি। ৩০ বছর বয়সের পর থেকে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি প্রতিদিন একটু হাঁটা, হালকা ব্যায়াম করা উচিত। অ্যালকোহল ও সিগারেট সেবনের অভ্যাসকে কমিয়ে দিতে হবে।
হাড় ঠিক রাখতে রোজের ডায়েটকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ করতে হবে। ক্যালশিয়ামের সাথে প্রোটিন, মিনারেলস, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। ডাল, মরশুমি ফল, শাকসবজির মতো পরিপূর্ণ আহার সঙ্গে রাজমা, বাদাম, বিনস, ব্রাউন ব্রেড ও সিরিয়ালস খাবার উপকারী। আমিষ খাদ্য হিসাবে সামুদ্রিক মাছ, চিকেন, চিংড়ি উল্লেখ্যযোগ্য। ছানা, দইয়ের মতো দুগ্ধজাত খাবারের সঙ্গে ব্রকোলি, সরষে, শালগম ও পালংশাক খাওয়া উপকারি। খাবারে নুনের পরিমাণ কমাতে হবে কারণ, অতিরিক্ত নুনের ব্যবহার খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট করে হাড়ের ক্ষতি করে। একটি সুস্থ জীবনশৈলী শরীরের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে হাড়ের গঠন, বিন্যাস ও স্বাস্থ্যকে ভাল রাখতে সাহায্য করে।