রমেন দাস: ‘ম্যায় তেরি দুশমন, দুশমন তু মেরা!’ বড়পর্দায় ‘নাগিনা’ ছবিতে শ্রীদেবীর নাচের কথা মনে আছে নিশ্চয়? কিন্তু সিনেমা ছাড়িয়ে বাস্তব! কে কার ‘দুশমন’ আসলে? সাপের ভয়ে মানুষ নাকি মানুষের ভয়ে সাপ! প্রশ্ন ওঠে, অত্যাধুনিক সমাজব্যবস্থা, তথাকথিত ‘এআই’ (Artificial Intelligence) রাজত্বের মধ্যেও সাপের কামড়ে (Snake Bite) মৃত্যু নিয়ে! তবে শুধু মৃত্যু নয়, সাপের কামড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় নানা কুসংস্কারও। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা এই পৃথিবীতে যা আজও উজ্জ্বল।
সাপ জুড়েই রয়েছে একাধিক মিথ (Myth)। ভয়ংকর, বিষধরদের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত মানুষ কখনও না বুঝেই পিটিয়ে মারেন ওদের। আবার অজান্তে নিঃশব্দ ঘাতকের ছোবলের পরেও ঝাড়ফুঁকে মত্ত হয় এই সমাজ। কিন্তু আধুনিকতার মোড়কেও রয়েছে একাধিক অলিখিত নিয়ম। ধরুন, ভোটকেন্দ্র (Polling Booth) থেকে সাপ তাড়াতে কার্বলিক অ্যাসিডের (Carbolic Acid) ব্যবহার! শুকনো লংকা পোড়ানো, আবার সর্পাঘাতের (Snake Bites) পরেই বাঁধন দেওয়ার চল! শহর-গ্রাম ভেদে এই টোটকার কথা বলেন অনেকেই। কোয়াক বা হাতুড়েদের নিদানে ওঝা ছাড়িয়ে বড় হয়ে ওঠে ‘বাঁধনরীতি’। কিন্তু আসল সত্যি কী, সাপের কামড়ের পরে কী করবেন আপনি! কী করবেন না? আবার মানবেন কোন নিয়ম, কী মানবেন না! বিষধরের ছোবলে মৃত্যু রোধে কী কী করণীয় আসলে – এই সব বিষয়ে উত্তর খুঁজেছে ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল’।
[আরও পড়ুন: কমছে স্বাদ, বাড়ছে বিপদ! ভোজনরসিকদের ‘তাণ্ডবে’ সংকটে ইলিশের ভবিষ্যৎ]
বহুদিন যাবৎ সাপ সংক্রান্ত বিষয়ে নিরন্তর গবেষণা করছেন চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদার। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের (National Medical College and Hospital) এই চিকিৎসক বলছেন, ”সাপে কামড়ালে এক মুহূর্তও দেরি নয়। সঙ্গে সঙ্গেই যেতে হবে নিকটবর্তী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।” দয়ালবন্ধু মজুমদারের দাবি, ”কোন সাপ কামড়াল, সে বিষযুক্ত না বিষহীন এসব ভাবার প্রয়োজন নেই। শুধু বুঝতে পারলেই শরণাপন্ন হতে হবে চিকিৎসকের।” ক্ষতস্থানে কিছুর প্রলেপ বা বাঁধন দেওয়া মানে আরও ক্ষতি ডেকে আনা, একথাও বলছেন ওই চিকিৎসক।
[আরও পড়ুন: গাছে ফুল-ফল নেই, ঝুলছে শুধু ‘শয়ে ‘শয়ে সাপ! যাবেন নাকি বিষধরদের বাগানে?]
এখানেই এক বিশেষ পন্থা অবলম্বন করার কথা বলছেন চিকিৎসক শুভেন্দু বাগ। তাঁর কথায়, ”চিকিৎসা পরিভাষায় ১০০ মিনিট নিয়মের দিকে এগোতে হবে আমাদের।” ঠিক কী এই নিয়ম? শুভেন্দু বাগের দাবি, ”সাপে কামড়ানোর পর ১০০ মিনিট (100 Minutes Rules) ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে যদি চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা যায় তাহলেই কমবে বিপদ।” ওই চিকিৎসকের কথায়, ”১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার এভিএস অর্থাৎ অ্যান্টিভেনাম সিরাম (Antivenom Serum) যদি রোগীর শরীরে দেওয়া যায় কোনও বিষাক্ত সাপের কামড়েই মৃত্যু হবে না কারও।”
চিকিৎসকদের কথায়, বাংলায় বিশেষত দক্ষিণবঙ্গেও সাপের কামড়ের পরে বাঁধন দেওয়ার একটা প্রচলন রয়েছে। এমনকী কার্বলিক অ্যাসিডের প্রয়োগে সাপ তাড়ানোর কথাও ভাবেন অনেকেই। শুভেন্দু বাগের দাবি, ”এই দুটি বিষয়ই অবৈজ্ঞানিক। একটিরও কোনও কারণ নেই।” চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদারের কথায়, ”বাঁধন বা তুকতাক করলে মৃত্যুর সম্ভাবনা আরও বাড়ে।” ঠিক একই মত চিকিৎসক আশিক ইকবালেরও। তাঁর কথায়, ”সাপে কামড়েছে , দেরি না করে যেকোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া বুদ্ধিমত্তার লক্ষ্মণ।” চিকিৎসক ইকবালের কথায়, ”সিনেমায় দেখানো দাঁত দিয়ে কামড়ে রক্ত চুষে নেওয়া অথবা ব্লেড দিয়ে ক্ষতস্থান কেটে সাপের বিষ শরীর থেকে বের করে ফেলা! এসব বুজরুকির কবলে না পড়ে সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় চিকিৎসা প্রয়োজন।”
কিন্তু কোন সাপ কামড়ালে বিপদ বেশি বুঝবেন কীভাবে? চিকিৎসক শুভেন্দু বাগের কথায়, ”এরাজ্যে মূলত বিষধর সাপের ক্ষেত্রে রয়েছে ফণাযুক্ত, ফণাহীন , এই দুই ধরনের সাপ রয়েছে। যাদের নিয়ে চিন্তা বেশি। ফণাযুক্ত অর্থাৎ কেউটে, গোখরো, শঙ্খচূড় বা কিং কোবরা (King Cobra) – যাদের বিষ অনুযায়ী নিউরোটক্সিক বলা হয়। আবার হিমোটক্সিক সাপ। যেমন, চন্দ্রবোরা। যে সাপের ফণা নেই। কিন্তু এর বিষও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই জাতীয় সাপের আঘাতে ১০০ মিনিটের নিয়ম পালন করা জরুরি।” ওই চিকিৎসক বলছেন, ”যদিও এর মধ্যেও রয়েছে বিভেদ। যেমন কালাচ বা কালচিতি সাপ। যার কামড়ে কোনও ক্ষত তৈরি হয় না। কিন্তু এই সাপেও থাকে মারণ বিষ।” তাহলে কীভাবে বুঝবেন কালাচের কামড়? শুভেন্দুর কথায়, ”কালাচ বা কালচিতির কামড়ের পরপরই বোঝা না গেলেও বেশ কিছুক্ষণ পর থেকেই দেখা যায় চোখের উপরের পাতা খুলতে সমস্যা হচ্ছে। অনেকটা শিবনেত্রর মতো হয়ে যায় চোখ। গলা ব্যথা শুরু হয়। পেট ব্যথার মতো উপসর্গও দেখা যায়।” ঠিক তখনই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার কথা বলছেন তিনি। চিকিৎসক আশিক ইকবাল এই প্রসংগে বলছেন, “কালাচ তো বটেই যেকোনও বিষধর সাপের কামড়ে শারীরিক নানা ক্ষতি হতে পারে। কারওর যদি আগে থেকেই অন্য কোনও রোগ থাকে সেক্ষেত্রে সাপের বিষের ধরন অনুযায়ী অসুস্থতা বা মৃত্যুর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ কিডনির রোগীকে বিষাক্ত সাপ কামড়ালে ওই রোগীর চিকিৎসা প্রয়োজন আরও আগে।”
সাপের হাত থেকে বাঁচতে কয়েকটি নিয়ম মানার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের কথায়, ধরন অনুযায়ী সাপ নোংরা, স্যাঁতসেতে জায়গায় অথবা গভীর জঙ্গলে থাকে। লোকালয়ে বা মানুষের মধ্যে তাদের আনাগোনা বাড়ে খাবারের তাগিদে। বহু সাপ মূলত ইঁদুর খায়। গৃহস্থের বাড়িতে ইঁদুর আসে নোংরা-আবর্জনা এবং পড়ে থাকা খাবার খেতে। এই ভাবেই ইঁদুর খেতে ঢোকে সাপ। তবে খুব বিষযুক্ত সাপের আনাগোনা সাধারণত কারও ঘরে কম থাকে। এক্ষেত্রে সতর্ক হলে এবং বাড়িতে কুকুর-বিড়াল (Pet) পোষ্য হিসাবে রাখলে সাপের প্রকোপ কমতে পারে বলেই মত চিকিৎসক দয়ালবন্ধু এবং শুভেন্দুরও।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর শুধুমাত্র এই রাজ্যেই সাপের কামড় খান কয়েক হাজার মানুষ। এর মধ্যে বিষধর সাপের কামড়ে মারা যান বহু। যাঁদের অধিকাংশই সময়মতো চিকিৎসা পাননি বলেই দাবি। তুকতাক, ঝাড়ফুঁকের ফলেই এই দশা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এমনও দাবি করেন কেউ কেউ। কিন্তু এতকিছুর পরেও ‘সাপুড়ের বিনের’ শব্দেই কেঁপে ওঠে সমাজ। বারবার বিজ্ঞানকে পদদলিত করেই বাঁধন আর কার্বলিকের বশে হারিয়ে যায় একেকটি জীবন। আসলে দায় কার? প্রশ্ন ওঠে বারবার কিন্তু উত্তর!