ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: নামেই মশা। আদতে রক্তবীজের ঝাড়! শুকনো জায়গায় অন্তত তিনবছর দিব্য বেঁচেবর্তে থাকে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস ইজিপ্টাই মশার লার্ভা। এই সময়ের মধ্যে যদি ওই জায়গায় একটু জল বা আর্দ্রতা পায়, ব্যস। ডিম ফুটতে যতটুকু সময়। সাত থেকে দশদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশা জন্মায়।
চমকের আরও বাকি। এডিস মশা এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যায় না। অত্যন্ত ভদ্র। টানা ৩২ বছরের গবেষণালব্ধ তথ্য হাতে নিয়ে এমনটাই জানিয়েছেন ড. গৌতম চন্দ্র। গৌতমবাবু বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কিন্তু আদতে পতঙ্গবিদ। অধ্যাপনার সঙ্গে এডিস ইজিপ্টাই-ডেঙ্গুর মশার বংশলতিকা নখদর্পণে তাঁর। ন্যাশনাল ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের তথ্য হাতে নিয়ে স্বাস্থ্যভবনের দিশেহারা অবস্থা। ঠিক সেই সময়ে অধ্যাপক গৌতম চন্দ্র বলছেন, ‘‘জল ছাড়াও স্ত্রী মশা ডিম পাড়ে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ধরুন বাড়িতে পুরনো কুয়ো বা চৌবাচ্চায় একফোঁটাও জল নেই। দিব্য শান্তিতে আছেন, মশার উপদ্রবের কোনও সুযোগই নেই। এমন ধারণাই ভুল। চৌবাচ্চা বা কুয়োর গায়ের ভিজে দেওয়ালে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস ইজিপ্টাই ডিম পেড়ে চলে যায়। তিনবছর ধরে একটু জল বা আর্দ্র পরিবেশের অপেক্ষা করে। অনুকূল পরিবেশ পেলেই ডিম ফোটে। পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সাত থেকে দশদিন। উপাচার্যের কথায়, এডিস ইজিপ্টাই বা ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী মশা ৩০-৩৫ দিন বেঁচে থাকে। তার মধ্যেই বংশবিস্তার ও সংক্রমণ ছড়ায়।’’
[আরও পড়ুন: রান্নাঘরের চালে গুটিসুটি মেরে বসে কে! বিশালদেহী সরীসৃপ দেখে আঁতকে উঠলেন বধূ]
স্বাস্থ্যভবনের পর্যবেক্ষণ, চলতি বছরে ডেঙ্গু সংক্রমণ কোনও একটা নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে হচ্ছে। যেমন বিধাননগর বা কলকাতা বা বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের কয়েকটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর সংক্রমণ লাগামছাড়া। কিন্তু পাশের এলাকায় সংক্রমণ নেই বললেই চলে। গৌতমবাবুর কথায়, এটাই স্বাভাবিক। কারণ মশা একটানা ১৫০-২০০ মিটার উড়তে পারে। তাই যেসব এলাকায় স্ত্রী মশার গতিবিধি বেশি সেখানেই সংক্রমণে রাশ পরানো যাচ্ছে না।’’ কলকাতা-সহ রাজ্যের প্রায় সব এলাকায় যখন পরিষ্কার জলে মশার লার্ভা খোঁজার কাজ চলছে সেই সময় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এই বক্তব্য চলতি সব ধ্যান-ধারণাকে নস্যাৎ করে দিল বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য দপ্তরের ভেক্টর কন্ট্রোল কর্তারা।
অধ্যাপক গৌতম চন্দ্রের মতোই রাজ্যের আরেক প্রবীণ পতঙ্গবিদ তথা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলতি ব্যবস্থা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। অমিয়বাবুর কথায়, ‘‘তেল ছিটিয়ে বা কামানের ধোঁয়ায় কখনও ডেঙ্গুর মশা ধ্বংস হয় না। কিছু সময় নেতিয়ে পড়ে। ফের স্বমূর্তি ধারণ করে।’’ তাহলে উপায়? অমিয়বাবু বলেছেন,‘‘যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি সেখানে নিবিড়ভাবে মশার লার্ভা খুঁজতে হবে। নষ্ট করতে হবে। এই কাজ বছরভর করতে হবে। বর্ষার আগে থেকে শুরু আর শীত শুরু হলে সব বন্ধ-এমনটা হলে ডেঙ্গুর মশা নষ্ট হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মনে রাখতে হবে, মশার চরিত্রের বদল হচ্ছে। দশবছর আগে যে কীটনাশক কাজ করত, এখন সেসব আর কাজ করে না। তাই নিত্য গবেষণা চালাতে হবে।”