কুণাল ঘোষ: ২৪ বছর আগে ১৯৯৮ সালের ২৩ ও ২৪ নভেম্বর ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর প্রথম পাতায় লিখেছিলাম- ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়েরও ৬০ বছর আগে এই বাংলার মেদিনীপুরের কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি দেশের প্রথম ব্রিটিশ—বিরোধী নারী বিদ্রোহী যোদ্ধা। সেই সময় অনেকে ভুরু কুঁচকেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন।
তার পর বহু ঘটনাক্রমের পর এই ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে লিখছি—— সম্মতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কর্ণগড় হতে চলেছে ‘হেরিটেজ জোন’। মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন জানাচ্ছেন, বিজ্ঞপ্তি জারি দিন কয়েকের মধ্যেই। তারপর রানির কেল্লা ও মন্দির সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা। পর্যটকদের জন্য পরিকাঠামোর কাজ হবে সম্পূর্ণ। ঘটনাটি এরকম—— ১৮৫৭ সালে ঝাঁসির রানির যুদ্ধের ৬০ বছর আগে চুয়াড় বিদ্রোহের আবহে ব্রিটিশ—বিরোধী লড়াই করেন রানি শিরোমণি। মিল অনেক। কর্ণগড়ের রাজা অজিত সিংহের দ্বিতীয় স্ত্রী শিরোমণি, সম্ভবত তিনিও আদিবাসীকন্যা। রাজার মৃত্যুর পর ইংরেজরা কর্ণগড়ের দখল নিতে গেলে শিরোমণি বাধা দেন। যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জঙ্গলমহলে তাঁর ফতোয়া ছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের জল বা খাবার দিয়ে সাহায্য করলে মৃত্যুদণ্ড। ব্রিটিশদের বন্দুক, ঘোড়া, কামানের বিরুদ্ধে লাঠি, বল্লম নিয়ে লড়েছিলেন আদিবাসীরা। জঙ্গলে সুবিধে করতে পারেনি ব্রিটিশরা। কথিত, শেষে রানির এক নায়েব বা প্রাক্তন প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতায় রানি ধরা পড়ে যান। বন্দি হন। বিচার হয়। দীর্ঘকাল বন্দিত্বের পর রহস্যমৃত্যু।
[আরও পড়ুন: একসঙ্গে মিলবে পাহাড়-নদী-জঙ্গলের স্বাদ, অ্যাডভেঞ্চার টুরিজমের নয়া ঠিকানা হাতিপাথর ]
প্রচলিত ইতিহাসে রানি এবং তাঁর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস উপেক্ষিত। অথচ একাধিক গবেষকের বই, স্থানীয় লোকগাথা, সাংস্কৃতিক স্রোতে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। মেদিনীপুর শহর থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলমহলের বুকে আজও রয়েছে পারাং নদীর ধারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রানির কেল্লার শেষাংশ। রানির মন্দিরটি অবশ্য চালু। মা মহামায়া, মা অভয়ার মূর্তি। দীর্ঘকাল পুজো করে আসছেন পুরোহিত শঙ্কর ভট্টাচার্য। ১৯৯৮ সালে এই উপেক্ষিত অধ্যায়ের প্রথম খবর পাই গবেষক আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভগতের সূত্রে। ডা. মানস ভুঁইঞার উদ্যোগে তৎকালীন একটি সম্মেলনের দলিল তৈরি করতে গিয়ে জেলার এক পুরনো লাইব্রেরির বই থেকে শিরোমণির উল্লেখ পান তীর্থঙ্কর। আমাকে বিষয়টি জানান মানস ভুঁইঞা। সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল থেকে কর্ণগড় যাই। গোটা এলাকা চষে ফেলি। ফিরে আরও নানা তথ্য সংগ্রহ করি। বিশ্বকোষ পরিষদ, সুপ্রকাশ রায়ের কৃষক বিদ্রোহ সংক্রান্ত বই—সহ বহু জায়গায় রানির উল্লেখ পাই। যদিও সবিস্তার স্পষ্ট ইতিহাস না থাকায় অনুসন্ধান কঠিন ছিল। যাই হোক, তখন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ রানিকাহিনি প্রকাশিত হয়—— ‘কর্ণগড়ের ক্ষুধিত পাষাণ’। সেই সময় কার্যত সবক’টি রাজনৈতিক দল রানির ইতিহাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতিতে এগিয়ে এসেছিল। রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শিরোমণি এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেন চালু করেন। রানিকে স্বীকৃতি।
সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু কর্ণগড় যান। অনিলদা জুতো হাতে পাজামা গুটিয়ে নদী পার হয়ে কেল্লাতেও যান। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মেদিনীপুর শহরে রানির সংগ্রাম ও চুয়াড় বিদ্রোহ স্মরণে সভা করেন। কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র, অতীশ সিনহাকে নিয়ে এলাকায় যান মানসবাবু। মেদিনীপুরে রানির স্বীকৃতির দাবিতে সভাও হয়। এবিষয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও চিঠি লিখেছিলেন মানসদা। বিজেপির মন্ত্রী তপন শিকদার জিওলজিক্যাল সার্ভেকে দিয়ে কেল্লার ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু কোনও কাজই সেভাবে আর এগোয়নি। তবে এলাকার রাস্তাঘাট, পরিকাঠামোর কিছু উন্নতি হয়। ১৯৯৮ সালে যা ছিল না, এখন মূল রাস্তা থেকে মন্দির পর্যন্ত পিচরাস্তা, তোরণ সব হয়েছে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোলে পর্যটকদের থাকার আবাস হচ্ছে হ্রদ ঘিরে। এর মধ্যেই প্রচলিত ইতিহাসে রানি শিরোমণির স্বীকৃতি এবং এলাকাটি হেরিটেজ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন করছে রানি শিরোমণি ঐক্য মঞ্চ। এতে শামিল একাধিক মঞ্চ—— ভালোবাসি কর্ণগড়, হেরিটেজ জার্নি, অখিল ভারতীয় ক্ষত্রিয় সমাজ, রানির আত্মোৎসর্গের দ্বিশতবর্ষ উদযাপন কমিটি, কুড়মি সেনা। এলাকার সংরক্ষণ, গবেষণার পাশাপাশি দাবি পাঠ্যসূচিতেও আনতে হবে রানি শিরোমণিকে।
জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকারের এই সংক্রান্ত একটি টিম ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছে। মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন নিজে দেখভাল করছেন বিষয়টি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই রানি সাম্রাজ্য হেরিটেজ জোন ঘোষণার বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। তারপর নিয়মমাফিক পদক্ষেপ হবে। রানির কেল্লা, মন্দির সুরক্ষা ও স্মারক বসানোর কাজ করবে রাজ্য সরকার। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘রানিসাহেবা’ বইটির মূল প্রেক্ষাপটই কর্ণগড় আর রানি শিরোমণি। ১৯৯৮ সালে একটি প্রতিবেদন দিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলাম এই উপেক্ষিত বঙ্গনারীকে স্বীকৃতির আলোয় আনার প্রার্থনায়। আজ শতকণ্ঠে এই দাবি সোচ্চার এবং রাজ্য সরকারের তৎপরতায় জঙ্গলমহলের উপেক্ষিত ইতিহাসে নতুন প্রাণসঞ্চারের সম্ভাবনা। আর সেই সঙ্গে দাবি আবারও থাক—— নতুন প্রজন্মের পাঠ্যসূচিতে আসুন রানি শিরোমণি। ভারতের প্রথম ব্রিটিশ—বিরোধী মহিলা বিদ্রোহিণীর সম্মানটা বাংলার জঙ্গলমহলের আদিবাসী রমণীরই প্রাপ্য। ইতিহাস নতুন করে কথা বলুক।