অসিত রজক, বিষ্ণুপুর: লোকসভা ভোটের মাঝে ভারতের উত্তর-পূর্বের বিজেপি শাসিত পাহাড়ি রাজ্য মণিপুর ফের রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে জঙ্গি হামলায়। শুক্রবার রাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর অস্থায়ী ছাউনিতে হামলায় যে দুই জওয়ান শহিদ হয়েছেন, তাঁদের একজন বাংলার। জঙ্গি হামলার বলি বাঁকুড়ার সোনামুখী থানার পাঁচাল গ্রামের বাসিন্দা অরূপ সাইনি। তিনি সিআরপিএফ বাহিনীর ১২৮ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের হেড কনস্টেবল ছিলেন। অরূপ সাইনির সঙ্গে ওই ব্যাটেলিয়ানের সাব ইন্সপেক্টর এন সরকারও শহিদ হয়েছেন। এছাড়া বোমা-গুলিতে গুরুতর জখম হয়েছেন ইন্সপেক্টর যাদব দাস এবং কনস্টেবল আফতাব দাস।
মণিপুরে জঙ্গি হামলায় শহিদ বাঁকুড়ার অরূপ সাইনি। নিজস্ব ছবি।
জানা গিয়েছে, লোকসভা নির্বাচনে (Lok Sabha Election 2024) জঙ্গি হামলা রুখতে মণিপুরের নারায়ণসিনা এলাকায় সিআরপিএফের ১২৮ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের একটি অস্থায়ী সেনাছাউনি বসানো হয়। সেখানেই কর্মসূত্রে ছিলেন বাংলার (West Bengal) জওয়ান অরূপ সাইনি। হেড কনস্টেবল ছিলেন অরূপ। সূত্রের খবর, শুক্রবার রাত ১২টা নাগাদ খাওয়াদাওয়ার পর ১২৮ নং ব্যাটেলিয়ানের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স বা সিআরপিএফের (CRPF) জওয়ানরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় তাঁবুতে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। এর কিছু সময় পরেই ওই ছাউনি থেকে কিছুটা দূরে একটি পাহাড় থেকে জঙ্গিরা বোমাবর্ষণ (Terror attack) শুরু করে। সেইসঙ্গে ছাউনি লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালানো হয়।
হামলা হয়েছে, বোঝামাত্রই হেড কনস্টেবল অরূপ সাইনি-সহ অন্যান্য জওয়ানরা জঙ্গিদের পালটা জবাব দেওয়া শুরু করেন। সেই সময় জঙ্গিদের শক্তিশালী বোমায় অরূপ সাইনির একটি পা ঝাঁজরা হয়ে যায়। গুলি লাগে সাব ইন্সপেক্টর এন সরকারের বুকে। বোমার আঘাতে লুটিয়ে পড়েন যাদব দাস এবং কনস্টেবল আফতাব দাস। প্রায় ভোররাত পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে গুলি-বোমার লড়াই চলতে থাকে। এর পর চারজনকেই তড়িঘড়ি মণিপুর (Manipur) সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অরূপ সাইনি এবং ইন্সপেক্টর এন সরকার শহিদ হয়েছেন বলে জানা যায়। বাকি দুজনের চিকিৎসা চলছে।
[আরও পড়ুন: ‘কল্যাণদার জন্যই আমাদের বিয়েটা হয়েছে’, কাঞ্চনকে ‘অপমান’ নিয়ে মুখ খুললেন শ্রীময়ী]
শুক্রবার সকালে গ্রামের ছেলের শহিদ হওয়ার খবর পাঁচালে পৌঁছয়। শোকের ছায়া নেমে আসে গ্রামে। নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অরূপের বাড়িতে রয়েছেন বাবা রমাকান্ত সাইনি, স্ত্রী পূর্ণিমা সাইনি ও তাঁদের ৫ বছরের এক মেয়ে, দেড় বছরের ছেলে। অরূপবাবুর ২ ভাই চাকরি সূত্রে ভিন রাজ্যে থাকেন। এদিন পাঁচালে গিয়ে দেখা যায়, গোটা গ্রাম জুড়ে থমথমে পরিবেশ। অরূপবাবুর বাড়ির সদস্যরা শোকে পাথর। তাঁরা কেউ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
বাঁকুড়ার পাঁচাল গ্রামের জওয়ান অরূপ সাইনি। নিজস্ব চিত্র।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৪ সালে তিনি সিআরপিএফ জওয়ান হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে (Indian Army) যোগ দেন। আগে জম্মু-কাশ্মীরে কর্মরত থাকলেও দেড় বছর আগে মণিপুরে বদলি হয়ে যান। এখানকার বিষ্ণুপুর জেলার এক ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন। শুক্রবার রাতে সেখানেই জঙ্গিরা হামলা চালায়। স্বামীর অকালমৃত্যুর শোক কোনওক্রমে সামলে অরূপবাবুর স্ত্রী পূর্ণিমা দেবী বলেন, ''নাবালক দুই সন্তানকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করার জন্য আর মাত্র এক বছর পরেই বন্ড শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসবে বলেছিল। পুজোর সময় তাঁর বাড়ি আসার কথাও ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল!''
[আরও পড়ুন: তিরন্দাজি বিশ্বকাপে সোনা জয়ের হ্যাটট্রিক, ফের বিশ্বমঞ্চে ভারতের জয়জয়কার]
সাইনি পরিবারের এক প্রতিবেশী সুধাংশু কড়ি বলেন, ''অরূপ খুব ভালো ছেলে ছিল। দেড় মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ও মণিপুরে কাজে যোগ দিতে যায়। বলেছিল, লোকসভা ভোট শেষ হয়ে গেলে ওদের অন্য জায়গায় পোস্টিং হবে। তখন আবার একবার গ্রামের বাড়িতে আসবে। অরূপের মা প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গিয়েছেন। সংসারে বাবা, স্ত্রী আর সন্তানরা রয়েছে। ভাইয়েরাও বাইরে থাকে। এখন কিভাবে ওঁদের চলবে সেটাই বুঝতে পারছি না।'' কথা ছিল, নির্বাচনের পর আবার বাড়িতে ফিরবে। কিন্তু নির্বাচন এখনও চলছে। তার মধ্যেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল তবে কফিনবন্দি হয়ে।