নন্দন দত্ত, সিউড়ি: বীরভূম জেলায় দুটি লোকসভা কেন্দ্র- বীরভূম ও বোলপুর। রাজ্যের ৪২তম সংসদীয় ক্ষেত্র এই বীরভূম। যার একদিকে ঝাড়খণ্ড, অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ জেলা। সংসদীয় ক্ষেত্রের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে ১৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। তার একদিকে শস্য-শ্যামল সবুজ ক্ষেত্রে অন্যদিকে বালি-পাথরের খাদান। জেলাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক সতীপীঠ ও পর্যটনক্ষেত্র। চাষাবাদ, খাদানের বালি-পাথর আর পর্যটনের ক্ষেত্র থেকেই জেলাবাসীর আয়। তবে সীমান্তবর্তী জেলা দিয়েই রমরমিয়ে চলে গরু, কয়লা, বালি পাচার। সেই পাচারচক্রকে হাতিয়ার করে ফুলেফেঁপে উঠেছে জেলার ব্যবসায়ীদের একাংশ। সিবিআই-ইডির লাগাতার অভিযানের দৌলতে সেই গল্প এখনও গোটা রাজ্যেরই জানা। তবে বীরভূমের পরিচয় দিতে গেলে একজনের নাম না নিলে গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তিনি তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। যদিও দাপুটে তৃণমূল জেলা সভাপতি আপাতত তিহাড়ে বন্দি।
জনবিন্যাস
বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে প্রায় ৩৫ শতাংশ সংখ্যালঘু, ৬ শতাংশ আদিবাসী মানুষের বাস। মূলতই কৃষিজীবী হলেও বর্তমানে পাথর ও বালি খাদানের জোরে অর্থনৈতিক বিকাশ হচ্ছে জেলার। গ্রামে বসবাসকারী ৮৫.৭৭ শতাংশ, শহরাঞ্চলে ১৪.২৩ শতাংশ, তফসিলি জাতি ২৯.০৩ শতাংশ, উপজাতি ৬.১১ শতাংশ।
বিধানসভা কেন্দ্র
বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে ৭ বিধানসভা-
- নলহাটি
- মুরারই
- হাসন
- রামপুরহাট
- সাঁইথিয়া
- সিউড়ি
- দুবরাজপুর
ইতিহাস
প্রথম লোকসভা নির্বাচন ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বীরভূম কেন্দ্রটি ছিল কংগ্রেসের দখলে। ১৯৭১ সালের লোকসভা ভোটে ক্ষমতা দখল করে সিপিএম। তারা ২০০৯ পর্যন্ত নিজেদের দখলে রেখেছিল কেন্দ্রটি। সে বছর লোকসভা ভোটে বীরভূমের লাল দুর্গে প্রথম সবুজ ফুল ফুটিয়েছিলেন শতাব্দী রায়। পর পর তিনবার তিনিই সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। এবার অনুব্রতহীন বীরভূমে ফের লড়াইয়ে নামছেন 'দিদির দূত' তারকা প্রার্থী।
[আরও পড়ুন: যতকাণ্ড যোগীরাজ্যে, সরকারি টাকা হাতাতে দিদির কপালেই সিঁদুর দিলেন ভাই!]
গত এক দশকের রাজনৈতিক চিত্র
২০০৯-এ লালদুর্গে ঘাসফুল ফোটে। এর পর গত দেড় দশক ধরে জেলায় দাপট দেখিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ২০১৩ সাল নাগাদ উত্থান হয় তাঁর। এর পর আর বিরোধীরা কবি গুরুর জেলায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। পঞ্চায়েত, বিধানসভা ও লোকসভায় সবুজ আবির উড়েছে জেলাজুড়ে। তবে পরিস্থিতিটা বদলায় ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে। নির্বাচনের আগে মাথা তুলতে শুরু করে গেরুয়া শিবির। জেলাজুড়ে একাধিক সতীপীঠ রয়েছে। রয়েছে বহ মন্দিরও। ফলে হিন্দুত্বের হাওয়া তোলা অনেক সহজ হয় বিজেপির পক্ষে। ২০১৮ সালের মাখরা গ্রামে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুলি চলে। সেই সময় আরএসএসের কেন্দ্রীয় নেতারা এসে জোর প্রচার চালান। ফলে বিজেপির গেরুয়া পতাকায় হাওয়া লাগে। বিজেপির পক্ষে জনসমর্থন বাড়লেও ভোটবাক্সে তার প্রমাণ মেলেনি।
হালফিলের হকিকত
২০১৯ সালে যখন রাজ্যজুড়ে মোদি হাওয়া বয়েছে তখনও তৃণমূলের তারকা প্রার্থী শতাব্দী রায় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির দুধকুমার মণ্ডলকে ৯০ হাজার ভোটে হারান। তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেবার বিজেপির ঝুলিতে ভোট বেড়েছিল ২০ শতাংশ। এর পর বীরভূমকে পাখির চোখ করে ঝাঁপিয়েছিল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, জেপি নাড্ডারা প্রচারে 'কার্পেট বম্বিং' করেও একুশে মাত্র একটি বিধানসভা আসনে-দুবরাজপুরে পদ্ম ফোটাতে সক্ষম হয়েছিল। লোকসভার বাকি ৬ আসনে জিতেছিলেন তৃণমূল প্রার্থীরাই। পঞ্চায়েতেও একই ট্রেন্ড বজায় ছিল। তবে গত লোকসভা ভোটের বীরভূমের সঙ্গে এবারের পরিস্থিতির একটা পার্থক্য রয়েছে। সেবার গোটা ভোট পরিচালনা করেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল আর এবার তিনি জেলবন্দি।
ফাইল ছবি।
অনুব্রত ফ্যাক্টর
এবার নির্বাচনী লড়াই অনুব্রতহীন লড়াই। এতোদিন তৃণমূলের তারকা প্রার্থী শতাব্দী রায় নিজের মতন ঘুরতেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ছিলেন 'মাস্টার প্ল্যানার'। নির্বাচনের খরচ থেকে ভোট পরিচালনা সবই ছিল তাঁর হাতে। কিন্তু এবার জেলার রাশ কোর কমিটির হাতে। কেষ্ট জেলায় না থাকায়, তাঁর জায়গা দখলের চেষ্টা করেছিলেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ। যার জেরে কিছুটা হলেও কোনঠাসা ছিল অনুব্রত ঘনিষ্ঠরা। দলের মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দ্ব দানা বাঁধে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তৃণমূল সুপ্রিমো কোর কমিটিতে কেষ্ট ঘনিষ্ঠদেরই স্থান দেন। আপাতত ভোট পরিচালনার রাশ তাদেরই হাতে। তবে দলের সর্বস্তরের কর্মীদের উপর অনুব্রতর রাশ যতটা ছিল, অন্য কারোর পক্ষে ততটা প্রভাব বিস্তার করা বেশ কঠিন।
[আরও পড়ুন: আরও বিপাকে রামদেব, পতঞ্জলির বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন মামলায় সুপ্রিম তলব যোগগুরুকে]
সম্ভাব্য প্রার্থী
তৃণমূলে প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রার্থী হয়েছে শতাব্দী রায়। বিজেপি এখনও প্রার্থী দিতে পারেনি। তবে হাওয়ায় একাধিক নাম ভাসছে। প্রার্থী দিতে পারেনি বাম -কংগ্রেসও। কিন্তু স্থানীয় এক চিকিৎসক আবদুল করিম ইতিমধ্য়ে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে সামনে রেখে বামেদের হয়ে প্রচার শুরু করেছেন। কংগ্রেসেরও মিল্টন রশিদও প্রচার শুরু করেছেন।
সম্ভাবনা
অনুব্রত না থাকায় এবার বীরভূম দখলের সুবর্ণ সুযোগ বিরোধীদের হাতে। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার সামান্য হলেও ব্যাকফুটে তৃণমূল। কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্বতে জেরবার বিজেপিও। জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এর জন্য হাজতবাসও করেছেন। ফের তাঁকেই সভাপতি করায় বিজেপির পুরনো কর্মীদের একাংশ বসে গিয়েছে। আবার তাঁর হাত ধরেই বিজেপিতে আনাগোনা বেড়েছে তরুণ প্রজন্মের কর্মীদের। ফলে জেলায় দ্বিমুখী লড়াই হলে ভালো লড়াই দেবে গেরুয়া শিবিরও। এদিকে বাম বা কংগ্রেস সংখ্যালঘু প্রার্থী দিলে ভোট কাটাকাটির খেলাও জমবে। আর ভোট কাটাকাটির খেলায় দেড় দশকের তৃণমূল সাংসদকে মাত দিতে পারে বিজেপি।