অর্ণব দাস, বারাকপুর: দূরত্বের নিরিখে কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছের লোকসভা কেন্দ্র উত্তর ২৪ পরগনার দমদম। রাজনীতির দিক থেকে অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় এই কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল না। কিছুটা এলাকা তৎকালীন কলকাতা উত্তর পশ্চিম এবং কিছুটা অংশ বারাকপুর কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে সাতের দশকে পুনর্বিন্যাসের ফলে তৈরি হয় দমদম লোকসভা কেন্দ্র। অধিকাংশ শিক্ষিত, চাকরিজীবী মানুষের বাস এই এলাকায়। তবে বেশ কিছুটা এলাকাজুড়ে রয়েছে কলোনি এলাকা। দেশভাগের পর সীমান্তের ওপাড় থেকে আসা লোকজনের একটা বিরাট অংশ এই লোকসভা অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে এলাকার রাজনৈতিক ইতিহাসও। কখনও কংগ্রেস কখনও বামেদের দখলে থেকেছে দমদম লোকসভা কেন্দ্রটি। বাংলার প্রথম বিজেপি সাংসদও নির্বাচিত হয়েছিলেন এই কেন্দ্র থেকে। গত দেড় দশক ধরে কেন্দ্রটি তৃণমূলের শক্তঘাঁটি। এবার কি ইতিহাস পথ বদলাবে নাকি ফের একবার সংসদে যাবেন সৌগত রায়?
লোকসভা পরিচিতি
দমদম এলাকার পরতে পরতে ইতিহাস। পলাশির যুদ্ধের 'ভিলেন' লর্ড ক্লাইভও সেইসময় দমদমে থাকতেন। নাগেরবাজার এলাকায় এখনও রয়েছে তাঁর বাসস্থান-ক্লাইভ হাউস। এ ছাড়া ইংরেজ সেনাদের থাকার জন্য এই এলাকায় তৈরি হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টও যা এখন শুধু নামটাই বহন করে চলেছে। এ ছাড়াও রয়েছে গোরাবাজার। দমদমে ইংরেজ আমলে তৈরি হয় দমদম সেন্ট্রাল জেল। সেই ঐতিহাসিক এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দমদম লোকসভা কেন্দ্র। তবে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে কেন্দ্রটি। একদিকে পানিহাটি থেকে দমদম, অন্যদিকে রাজারহাট গোপালপুর অঞ্চলও রয়েছে এই কেন্দ্রের অন্তর্গত। অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা হল-
- খড়দহ
- দমদম উত্তর
- পানিহাটি
- কামারহাটি
- বরানগর
- দমদম
- রাজারহাট-গোপালপুর
[আরও পড়ুন: আপনাদের সাক্ষাৎ পাওয়া আল্লার মেহেরবানি, রেড রোডের নমাজ কোনওদিন মিস করব না: মমতা]
জনবিন্যাস
ভোটার সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ। অধিকাংশই হিন্দু ভোটার। সংখ্যালঘু বা মুসলিম ভোটার সংখ্যা অনেকটাই কম। অধিকাংশই শহুরে ভোটার। রাজনৈতিকভাবে সচেতনও।
ইতিহাস
কেন্দ্রের প্রথম লোকসভা নির্বাচন হয় ১৯৭৭ সালে। সেই সময় সাংসদ হয়েছিলেন জনতা পার্টির অশোককৃষ্ণ দত্ত। ১৯৮০-র ভোটে জিতে ১৯৮৪ পর্যন্ত লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব করেন বামেদের নীরেন ঘোষ। এর পর হাত বদল হয়ে ১৯৮৪ সালে নির্বাচিত হন কংগ্রেসের আশুতোষ লাহা। ফের ১৯৮৯-এ পালা বদল। ১৯৮৯-৯৮ পর্যন্ত বামদের নির্মলকান্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দমদমের সাংসদ। ১৯৯৯ সালে বাংলার প্রথমবারের জন্য বিজেপি সাংসদ পায় বাংলা। এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তপন শিকদার। তবে ২০০৪-এ আসনটি পুনরুদ্ধার করেন বামেদের অমিতাভ নন্দী। কিন্তু এর পর থেকেই হাওয়া অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করে। ২০০৯ সালে তৃণমূলের টিকিটে জয়লাভ করেন সৌগত রায়। এখনও পর্যন্ত সেই ট্রেন্ডই চলছে।
গত এক দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
বাম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর গড় হিসেবে পরিচিত দমদমে এখন তৃণমূলের হাওয়া। ২০০৯ থেকে পর পর লোকসভা ভোটে জয় পেয়েছেন তৃণমূলের সৌগত রায়। তবে উনিশের লোকসভায় সৌগতকে লড়াই দিয়েছিলেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। তবে ৬০ হাজার ভোটে হারতে হয়েছিল তাঁকে। অর্থাৎ এলাকায় দ্বিতীয় শক্তি উঠে এসেছিল বিজেপি। একুশের লড়াইতেও সেই ট্রেন্ড বজায় রাখতে কিছুটা সফল হয়েছিল গেরুয়া শিবির।
শেষ বিধানসভা ভোট অর্থাৎ একুশের লড়াইয়ে ৭ বিধানসভায় জয় পেয়েছে তৃণমূল। খড়দহ, বরানগর, কামারহাটি, পানিহাটি, উত্তর দমদম-সহ মোট সাত আসনেই দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি। পুর এবং পঞ্চায়েত ভোটেও তৃণমূলের জয়জয়কার।
সম্প্রতি একাধিক দলবদলের ঘটনা ঘটেছে এই কেন্দ্রে। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তাপস রায়, বরানগরের পদত্যাগী তৃণমূল বিধায়ত। দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দল ছেড়েছিলেন। বিজেপির টিকিটে কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের প্রার্থী তিনি।
[আরও পড়ুন: রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত! ফব’কে বিঁধে সেলিমের তোপ, ‘বেশি কথা বলবেন না’]
প্রার্থী পরিচয়
তিন হেভিওয়েটের লড়াই দমদমে। দলের পুরনো 'ঘোড়া' সৌগত রায়ে আস্থা রেখেছে তৃণমূল। জনসভার পাশাপাশি মিছিল-দলীয় বৈঠক করছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে সুজন চক্রবর্তীকে প্রার্থী করেছে বামেরা। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে নিজস্ব কায়দায় প্রচার চালাচ্ছেন বামনেতা। এই দুজনের বিরুদ্ধে বারাকপুরের প্রাক্তন 'দলবদলু' কাউন্সিলর শীলভদ্র দত্তকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। প্রার্থী নিয়ে দলের অন্দরেই ক্ষোভ রয়েছে।
সম্ভাবনা
দমদম এবার তিন 'স'-এর লড়াই। এবার সরাসরি ত্রিমুখী যুদ্ধে সেখানে। পানিহাটি ও বরাহনগর বিধানসভা কেন্দ্রের দলের অন্দরে কিছুটা অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকলেও সৌগত রায় জয়ের পথে বেশকিছুটা এগিয়ে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কারণ, ভোটের ফলের দিকে নজর রাখলে বোঝা যায়, বামের ভোট রামের ঘরে গিয়েছে। এবার হেভিওয়েট প্রার্থী দেওয়ায় সেই ভোট বামের ঘরেই ফিরবে। ফলে লালশিবিরের ভোট শতাংশ অনেকটাই বাড়বে বলে আশা। অন্যদিকে শীলভদ্র দত্তকে নিয়ে বিজেপির অন্দরে ক্ষোভ রয়েছে। আবার বামের ভোট 'ঘরে' ফিরলে স্বাভাবিকভাবেই কমবে গেরুয়া শিবিরের প্রতি সমর্থনও। আর ভোট কাটাকাটির এই অঙ্কে সুবিধা পাবে রাজ্যের শাসক দলই।