সর্বজয়া রায়: ভোটের আবহ বা জৌলুস সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায় বড় শহরগুলিতে। আর বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা (Kolkata) রাজনৈতিকভাবে বেশ সচেতন। বড় বড় হোর্ডিং, ব্যানার বিজ্ঞাপন কিংবা অভিনব প্রচার, অনেকটাই দেখা যায় শহরাঞ্চলে। কলকাতা উত্তর এমনই এক কেন্দ্র, যেখানে শুধু রাজনৈতিক সচেতনতাই নয়। নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর রয়েছে। ধর্মীয় ভাবাবেগ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ ভোটারদের উপর প্রভাব ফেলে। যে কারণে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এই কেন্দ্রে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নিয়ে থাকে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, জনপ্রিয়, একইসঙ্গে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দুঁদে ব্যক্তিত্বকে জনপ্রতিনিধির লড়াইয়ে নামাতে তৎপর থাকে দলগুলি। চব্বিশের লোকসভা ভোটেও (Lok Sabha Election 2024) তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে এবার এই কেন্দ্রের লড়াই বেশ অন্যরকম হতে চলেছে বলে অনুমান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। তার কারণ অবশ্যই প্রার্থী নির্বাচন। দেখে নেওয়া যাক কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের চব্বিশের লড়াই কেমন হতে চলেছে।
ইতিহাস
কলকাতা উত্তর (Kolkata Uttar) লোকসভা কেন্দ্রের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। ২০০২ সালে পুনর্বিন্যাস নিয়ে কমিশনের নির্দেশিকা অনুসারে কলকাতা উত্তর পশ্চিম ও কলকাতা উত্তর পূর্ব লোকসভা কেন্দ্র দুটি অবলুপ্ত হয় এবং নতুন করে গঠিত হয় কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র। মেঘনাদ সাহা নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত সাংসদ হন। তার পর অবশ্য এই কেন্দ্রের দখল নিয়েছে রাজ্যের শাসকদল।
জনবিন্যাস
কলকাতার উত্তরাংশ অর্থাৎ এই লোকসভা কেন্দ্রের জনবিন্যাস একেবারেই মিশ্রিত। এখানে হিন্দু বাঙালির পাশাপাশি বিহারী, মাড়োয়ারি অর্থাৎ বাংলার বাইরের মানুষজনের বসবাস রয়েছে। সেই সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। এছাড়া কোনও কোনও এলাকা মুসলিম, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের গড়। ফলে মিশ্র জনবসতিই এখানকার বিশেষত্ব। তফসিলি জাতি-উপজাতি মিলিয়ে সেই জনসংখ্যা প্রায় ৫ শতাংশ।
[আরও পড়ুন: বিজেপি প্রার্থীর পা ছুঁয়ে প্রণাম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের শশীর, ভোটবাজারে বিরল ছবি]
বিধানসভা কেন্দ্র
কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রগুলি -
- চৌরঙ্গি
- এন্টালি
- বেলেঘাটা
- জোড়াসাঁকো
- শ্যামপুকুর
- মানিকতলা
- কাশীপুর-বেলগাছিয়া
২০২১ সালের ফলাফল অনুযায়ী, এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রই তৃণমূলের দখলে।
অতীতের নির্বাচনী ফলাফল
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের হেভিওয়েট প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে পরাজিত করে সাংসদ হন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (Sudip Bandyopadhyay)। তাঁর ঝুলিতে এসেছিল ৪ লক্ষ ৬০ হাজারের বেশি ভোট। সাড়ে তিন লক্ষের সামান্য বেশি ভোট পায় সিপিএম। মাত্র ৪.২২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থী তথাগত রায়।
২০১৪ সালে তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জিতলেও তাঁর প্রাপ্ত ভোট কমে যায়। প্রায় ২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন বিজেপির রাহুল সিনহা। তৃতীয় স্থানে থাকা রূপা বাগচির ঝুলিতে আসে ২০ শতাংশের বেশি ভোট।
পরেরবার অর্থাৎ ২০১৯ সালে দারুণ ফলাফল করে ঘাসফুল শিবির। ৫০ শতাংশ ভোট একাই ঝুলিতে ভরেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির রাহুল সিনহা পেয়েছিলেন ৩৭ শতাংশ ভোট।
কলকাতা উত্তরের বিদায়ী সাংসদ তথা তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রার্থী পরিচয়
কলকাতা উত্তর জিততে তৃণমূল ফের আস্থা রেখেছে তিনবারের জয়ী সৈনিক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। বাম-কংগ্রেস সমঝোতা করে এই কেন্দ্রে বর্ষীয়ান কংগ্রেস (Congress) নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁর সমর্থনে প্রচার করছেন স্বয়ং বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তবে এই কেন্দ্রে প্রার্থী বাছাইয়ে চমক দিয়েছে বিজেপি। সদ্য দলবদলকারী প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় (Tapas Roy)। ভোটের দামামা বাজার ঠিক আগেই তাঁর বাড়িতে ইডির হামলার পর দলবদলের সিদ্ধান্ত নেন তাপসবাবু। এবং ভাবনামতোই কাজ। আর গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে তাপস রায়কে প্রার্থী করা হয়েছে। এখানে মূল প্রতিপক্ষ একদা দুই সতীর্থ - সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস রায়। আর সেটাই বিজেপির বাজি। যেখানে তৃণমূলের শক্তি জনপ্রিয়, অভিজ্ঞ বিদায়ী সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতা উত্তরের বিজেপি প্রার্থী, সদ্য দলবদলকারী তাপস রায়।
[আরও পড়ুন: ‘সংবিধান বদলের ষড়যন্ত্রকারীদের চোখ উপড়ে নেওয়া হবে,’ হুমকি লালুর]
সম্ভাবনা
কলকাতা উত্তরের নির্বাচনী লড়াই যে এবার বেশ আকর্ষণীয় হতে চলেছে, তা প্রার্থী পরিচয়েই বোঝা গিয়েছিল। তবে শুধু প্রার্থীতে নয়, রয়েছে আরও অনেক ফ্যাক্টর। সুদীপ বিরোধী চোরাস্রোত এখানে প্রবল। লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। একদিকে সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর বিজেপির নজর ৩৯ শতাংশ অবাঙালি ভোটে। তবে অবাঙালি বলয়ে ভোটদানের হার কম। বাঙালি হিন্দু ভোট সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে। অপরদিকে, সিপিএম এখানে আলাদা করে প্রার্থী না দেওয়ায় বামেদের ভোট রামে যাওয়ার সম্ভাবনা। আগামী ১ জুন, শেষ দফায় এখানে ভোটগ্রহণ।