মণিরুল ইসলাম, উলুবেড়িয়া: হাওড়া জেলার দুই লোকসভা কেন্দ্র- হাওড়া এবং উলুবেড়িয়া। আমাদের আলোচনা উলুবেড়িয়াকে নিয়ে। উলুবেড়িয়ার দুদিক ঘিরে রেখেছে হুগলি জেলা-শ্রীরামপুর, খানাকুল। একদিকে রয়েছে হাওড়া সদর। আরেকদিকে রয়েছে হুগলি নদী। এলাকার অর্থনীতি মিশ্র। উলুবেড়িয়া, বাগনানের অর্থনীতি কলকাতা নির্ভর। আবার আমতা, উদয়নারায়ণপুর, শ্যামপুর এলাকার অর্থনীতি আবার কৃষিভিত্তিক। এর পাশাপাশি ইট শিল্পের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এলাকার অর্থনীতি। পাশাপাশি রয়েছে ৭-৮টি চটকল। রয়েছে ছোট-ছোট বেসরকারি কলকারখানা। তবে অর্থনীতি যতই মিশ্র হোক, রাজনীতি কিন্তু একমুখী। সাধারণত রাজ্যে যে দল ক্ষমতায় থাকে জেলার একচেটিয়া ভোট যায় তার ঝুলিতেই। হাওড়া একমাত্র জেলা যেখানকার সবকটি বিধানসভা অর্থাৎ ১৬টি বিধানসভাই তৃণমূলের দখলে। স্বাভাবিকভাবে লোকসভা নির্বাচনের আগে কিছুটা হলেও এগিয়ে ঘাসফুল শিবির। হাওড়ার জগৎবল্লভপুর এবং ডোমজুড় কেন্দ্রটি শ্রীরামপুর লোকসভার অধীনে। সেই দুটিও তৃণমূলের দখলে।
বিধানসভা কেন্দ্র
এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা কেন্দ্র-
- উলুবেড়িয়া উত্তর
- উলুবেড়িয়া মধ্য
- উলুবেড়িয়া দক্ষিণ
- শ্যামপুর
- বাগনান
- আমতা
- উদয়নারায়ণপুর
[আরও পড়ুন: গাড়িতে রক্তের দাগই ধরিয়ে দিল ‘খুনি’কে! ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিউ টাউনে ট্রলি ব্যাগে দেহ রহস্যের কিনারা]
জনবিন্যাস
এই লোকসভা কেন্দ্রের ৩৩ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বাকিটা হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটার। এর মধ্যেই বেশকিছুটা রয়েছে তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতির ভোট। কেন্দ্রটি সীমান্ত এলাকায় নয় ফলে শরণার্থীর ভোটের ফ্যাক্টর এখানে নেই।
ইতিহাস
টানা সাতবারের সাংসদ ছিলেন সিপিএমের হান্নান মোল্লা। ২০০৯ সালে প্রথম সেটি তৃণমূলের দখলে আসে। হান্নান মোল্লাকে পরাজিত করেন সুলতান আহমেদ। সেই থেকে কেন্দ্রটি এখনও তৃণমূলের হাতেই রয়েছে। তবে এখন এখানকার সংসদ সুলতান আহমেদের স্ত্রী সাজদা আহমেদ। ২০১৭ সালে সুলতানের মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের উপনির্বাচনে প্রার্থী হন সাজদা। প্রয়াত সুলতানকে সামনে রেখে ব্যাপক মার্জিনে জয়ী হন। তার পর উনিশেও তিনি প্রার্থী ছিলেন, জয়ী হন। বর্তমানে উলুবেড়িয়া লোকসভা আসনটি তৃণমূলেরই শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। ২০০৯ সালের পর থেকে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে সবসময়ই দ্বিতীয় স্থানে ছিল বামেরা। ২০১৯-এ সেই স্থান দখল করে বিজেপি।
সম্ভাব্য প্রার্থী
এবার সাজদা আহমেদকেই তৃণমূল প্রার্থী করেছে। বিজেপি এখনও প্রার্থী দিতে পারেনি। তবে উলুবেড়িয়ার হাওয়ায় ভাসছে একাধিক নাম। কখনও শোনা যাচ্ছে বিজেপির হয়ে সাজদা আহমেদ বিরুদ্ধে লড়াই করবেন মাফুজা খাতুন। কখনও আসছে মামুল আখতারের নাম। কেউ কেউ আবার বলছেন বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়াতে পারেন তারকা ক্রিকেটার মহম্মদ শামি। বাম-কংগ্রেসও প্রার্থী দেয়নি এখনও। তবে আইএসএফও এই কেন্দ্রে প্রার্থী দেবে বলে খবর।
হালফিলের হকিকত
২০১১ সালে ক্ষমতা বদলের সময় কংগ্রেস এবং তৃণমূলের জোট থাকায় আমতা বিধানসভা কেন্দ্রটিতে কংগ্রেসের অসিত মিত্র জয়ী হয়েছিলেন। ফলে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে একটি ছিল কংগ্রেসের দখলে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম কংগ্রেসের জোট হয়। তখনও প্রার্থী হয়েছিলেন অসিত মিত্র। তৃণমূল প্রার্থী তুষার শীলকে হাজার দুয়েক ভোটে হারিয়ে ফের একবার বিধায়ক হন তিনি। এর পর ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে আগে থেকে
বিজেপির উত্থান শুরু হয়। তবে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে কেন্দ্রটি প্রথম তৃণমূলের দখলে আসে। ফলে বর্তমানে উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলেরই দখলে রয়েছে।
গত ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পর থেকে প্রত্যেকটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল আরো ভালো ফল করেছে। ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলার ১৫৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত ছিল বিজেপির হাতে। বাকি সব ছিল তৃণমূলের। ১৪টি পঞ্চায়েত সমিতিই ছিল তৃণমূলের হাতে। জেলা পরিষদে ৪০টির মধ্যে একটি আসনে নির্দল জয়ী হয়েছিল।
এর পর ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও একটি পঞ্চায়েতেও তারা বোর্ড গঠন করতে পারেনি। উলটে এখানে উত্থান হয় আইএসএফের। আইএসএফ, বাম এবং কংগ্রেসের জোটের হাতে এই মুহূর্তে উলুবেড়িয়া লোকসভা এলাকার দুটি পঞ্চায়েত রয়েছে। বাইনান এবং তেহট্টো কাটাবেরিয়া দু’নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত দুটি রয়েছে জোটের হাতে। বিজেপির সমস্ত পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়। পঞ্চায়েত সমিতি যথারীতি তৃণমূলের হাতে। জেলা পরিষদে বর্তমান আসন সংখ্যা ৪২। সবকটিই তৃণমূলের দখলে।
[আরও পড়ুন: বিজেপি প্রার্থী কোথায়? দূরবীন দিয়ে খুঁজছেন মহুয়া-সায়নী]
সম্ভাবনা
সবসময়ই দেখা গিয়েছে উলুবেড়িয়ার ভোটাররা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ। এই লোকসভা কেন্দ্রে কোনওরকম বড়সড় দলবদল হয়নি নেতানেত্রীদের। বছর কয়েক আগে বাগনান এলাকার নিচুতলার প্রভাবশালী এক তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যোগদান করেন। তবে তার নিটফল শূন্য। কোনও প্রভাবই রাজনীতিতে পড়েনি। কেন্দ্রটি সীমান্ত এলাকায় নয়, ফলে শরণার্থীর ভোটের ফ্যাক্টর এখানে নেই। সংখ্যালঘু ভোট এখানে বড় অংশের। যেটা তৃণমূলকে কিছুটা স্বস্তিতে রেখেছে। যদিও আইএসএফ প্রার্থী দিতে পারে এই কেন্দ্রে। সেক্ষেত্রে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে কি থাবা বসাতে পারবে নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী প্রকল্প, ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি মানুষের মন কাড়বে? উত্তর মিলবে ৪ জুন। যদিও সার্বিকভাবে এই কেন্দ্রে তৃণমূলই এগিয়ে রয়েছে বলা যায়।