সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: কাড়াকে (মহিষ) হলুদ রঙে সাজিয়ে জঙ্গলমহলে ভোট প্রচারে নজর কেড়েছিলেন কুড়মি প্রার্থী। এবার 'জজলং টাইগার' নামে একটি কাড়ায় চড়ে শুক্রবার মনোনয়ন জমা দিলেন পুরুলিয়ার কুড়মি প্রার্থী অজিতপ্রসাদ মাহাতো। তাঁর হাতে ছিল সংবিধানও। একটু অবাস্তব ঠেকছে? কিন্তু এদিন দুপুরে শহর পুরুলিয়ার মানুষজন যে এই ছবিই দেখলেন। তবে শুধু কাড়া নয়। প্রার্থীর পাশে হাঁটল শিংওয়ালা ভেড়া। সঙ্গে মোরগও।
শেষ নয় এখানেই। টুসু পরবের মতো হাজির ছিল একাধিক রঙবাহারি চৌডল, করম পরবের জাওয়া। সেই সঙ্গে ধামসা, মাদল-সহ হারিয়ে যাওয়া নানা বাদ্যযন্ত্র। মানভূম সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থেই জাতিসত্তার লড়াইয়েই মনোনয়ন (Nomination) পর্বে এমন অভিনব আয়োজন। যেখানে কুড়মিদের পতাকার হলুদ রঙে মিলিয়ে গলায় গামছা, কপালে ফেট্টি, মাথায় ছাতা। সেই সঙ্গে হলুদ রঙা বেলুন। সব মিলিয়ে একেবারে রঙিন মনোনয়নের মিছিল। মিছিল বোধহয় সঠিক শব্দ নয় এখানে। বলা ভালো, আদিবাসী কুড়মি সমাজের মূল মানতা (প্রধান নেতা) তথা কুড়মি প্রার্থীর (Kurmi) মনোনয়ন পর্বে জনজোয়ার। যার জেরে ভেঙে গেল পুরুলিয়া প্রশাসনিক ভবনে যাওয়ার ব্যারিকেড। তখন হুলস্থুল অবস্থা পুলিশের।
[আরও পড়ুন: রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তদন্তে SET গঠন, শ্লীলতাহানির অভিযোগ ‘অবিশ্বাস্য’, দাবি জেলবন্দি পার্থর]
চারদিকে শুধু কালো মাথা আর হলুদ রঙায় প্রখর গ্রীষ্মেও যেন বসন্ত! না হলে পুরুলিয়ার (Purulia) ৪০ ডিগ্রি চোখ রাঙানিতেও মনোনয়নের উপচে পড়া ভিড়ে প্রায় দুপুর একটা থেকে দুটো পর্যন্ত এক ঘন্টা শহর পুরুলিয়া যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। যানজটের ফাঁসে আটকে যায় প্রায় সমগ্র শহরই। তবে রঙিন মনোনয়নে জনজোয়ার কিন্তু অন্য সংকেত দিয়ে গেল। বিজেপি 'ভোট কাটুয়া' বললেও এদিনের ভিড় দেখে জেলার রাজনৈতিক মহল বলছে, অন্যতম মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন কুড়মি প্রার্থী অজিতপ্রসাদ মাহাতো। তিনি বলেন, "মানভুঁইয়া সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। কাড়া লড়াইয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী পরবকে প্রশাসন বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। জাতিসত্তার লড়াইয়ের সঙ্গে সাবেক মানভূমের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখারও সংগ্রাম। সেই কারণেই মনোনয়ন পর্বে আমাদের এমন আয়োজন। আজ বিজেপির জন্য দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হচ্ছে। তাই হাতে সংবিধান নিয়েই মনোনয়ন জমা করতে যাই। যে বিজেপি (BJP) আমাদেরকে 'ভোট কাটুয়া' বলছে, তারা এবার তিনে চলে যাবে। আমাদের লড়াই হবে তৃণমূলের (TMC) সঙ্গে। জয়ী হব আমরাই। কারণ আমাদের হাতে ৩৫ শতাংশ কুড়মি ভোট। সঙ্গে হিতমিতান অর্থাৎ একাধিক সামাজিক সংগঠন রয়েছে। এই বিজেপি আমাদের জন্য কোনও কিছু করেনি। বিজেপির সাংসদ তথা প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো যদি চাইতেন আদিবাসী তালিকাভুক্তের দাবি তিনি সংসদে তুলতেন। অন্যদিকে রাজ্যের দু'বারের মন্ত্রী তৃণমূলের শান্তিরাম মাহাতো কুড়মি হয়েও জনজাতির পাশে নেই। এর জবাব মানুষ ভোটে দেবেন।"
টুসু পরবের মতো হাজির ছিল একাধিক রঙবাহারি চৌডল, করম পরবের জাওয়া। সেই সঙ্গে ধামসা, মাদল-সহ হারিয়ে যাওয়া নানা বাদ্যযন্ত্র। ছবি: সুনীতা সিং।
মনোনয়ন পর্বে কোটশিলা থানার জজলং গ্রামের কাড়া যাতে বিগড়ে না যায়, তাই সকালে ভরপেট খাওয়ানো হয়। কাড়ার রসিক মাহিন্দি মাহাতো বলেন, "এই কাড়াকে একেবারে ছোট থেকে বড় করেছি। এখন বয়স ১৩ বছর। গ্রামের বাড়ি থেকে পুরুলিয়া শহরে পিকআপ ভ্যানে নিয়ে আসার আগে ২ কিলো চালের গুঁড়ো, ৩ কিলো ধানের গুঁড়ো, ২ কিলো আটা, ১ কিলো ভুট্টা ও ৩৫ কিলো ঘাস খাইয়েছি। সঙ্গে জল তো খেয়েইছে। আমার মোট ১২ টা কাড়া রয়েছে। এই কাড়ার নাম জজলং টাইগার।"
[আরও পড়ুন: ছিলেন ডাক্তার, হয়ে গেলেন দুধ বিক্রেতা! সিদুঁরদানের আগেই মুখোশ খুলল ‘গুণধরে’র, তার পর…]
২০১৬ সালে যখন কাড়া লড়াই বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিল পুলিশ। সেইসময় এই 'জজলং টাইগার'কে নিয়েই বরাবাজার ও কোটশিলায় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিল আদিবাসী কুড়মি সমাজ। সেই 'জজলং টাইগার'-কে হলুদ রঙে সাজিয়ে ভোট প্রচারে নামানো হয়। কাড়া লড়াইয়ের পাশাপাশি মোরগ লড়াইকেও বাঁচিয়ে রাখতে আড়শা থানার ঝুঁঝকা থেকে মিলনচন্দ্র মাহাতো মোরগ নিয়ে এসেছিলেন। জঙ্গলমহলের মানুষ যে প্রাণীপালনের উপর নির্ভরশীল। তাই সেই আবেগেই কেন্দা থানার জামবাদ থেকে হিমাংশু ও রাজেশ মাহাতো ২ টো শিংওয়ালা ভেড়া নিয়ে প্রার্থীর সামনে মনোনয়নে হাঁটানো হয়।
কিন্তু সরকারি বিধি বলছে, প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ আইন, ১৯৬০ অনুযায়ী পশুদের উপর অপ্রয়োজনীয় ব্যথা বা কষ্ট দেওয়া যায় না। এই কারণেই এই জেলায় ২০১৬ সালে 'কাড়া লড়াই' বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল পুলিশ। কিন্তু আবেগের কাছে যেন হার মানে আইন। তবে কাড়া লড়াইয়ের কোথাও অনুমতি দেয় না পুলিশ। এই কারণেই মানভুঁইয়া সংস্কৃতি রক্ষায় মনোনয়ন পর্বে এমন বার্তা কুড়মি প্রার্থীর।
দেখুন ভিডিও: