shono
Advertisement

ফিরে দেখা ২০২২: অর্থ-অনর্থ! রাজ্যজুড়ে টাকার পাহাড়, দুর্নীতিতে নাম জড়াল যে রাজনীতিকদের

চলতি বছর পরপর বঙ্গ রাজনীতির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর জেলযাত্রা হয়েছে।
Posted: 12:48 PM Dec 27, 2022Updated: 12:48 PM Dec 27, 2022

বাঙালির রক্তে রয়েছে অমোঘ এক নেশার টান। কী জ্ঞানার্জনের নেশা, কী রোমাঞ্চের। এসব নেশার কারণে আমরা কিন্তু এতদিন নিন্দিত হইনি, হয়েছি নন্দিত। কিন্তু ২০২২-এ এ কী হল? আমরা দেখলাম নেশার এক কদর্য রূপ! উঁচু নয়, মাথা হেঁট হল বাঙালির। জুড়ে গেল রাজনীতির সঙ্গে সীমাহীন দুর্নীতি। ক্ষমতা আর অর্থের জোড়া কাঁধে ভর করে অদম্য আসক্তির বিজ্ঞাপন হয়ে উঠল ‘টাকার পাহাড়’! এ রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, তাঁর ‘বান্ধবী’ থেকে বীরভূমের ‘বেতাজ বাদশা’, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি থেকে কর্মী – সকলেই হেসেখেলে হার মানালেন কুবেরকেও। তাঁদের গোপন কুঠুরিতে গুপ্তধন দেখে দুঁদে গোয়েন্দাদের ‘চোখে ঝিলমিল’ লেগে যাওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। বছর শেষে এই ‘অর্থ-অনর্থে’র সাপলুডো খেলার রিওয়াইন্ড সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালে

Advertisement

পরেশ অধিকারী: রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা কালিমালিপ্ত করার নেপথ্যে প্রথম নাম যাঁর আসে, তিনি পরেশ অধিকারী (Paresh Adhikari) । রাজ্যের মন্ত্রী অথচ এতদিন তাঁর নাম সেভাবে শোনা যায়নি। কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের বিধায়ক শিক্ষা দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী। আর সেই ‘ক্ষমতা’র জোরে নাকি তিনি নিজের মেয়েকে কাছের স্কুলে চাকরি ‘পাইয়ে’ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এক যোগ্য চাকরিপ্রার্থীর আইনি লড়াইয়ে মন্ত্রীকন্যার শিক্ষকতার চাকরি বাতিল হয়। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, পরেশ অধিকারীর পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুদের অনেকেই স্রেফ ‘মন্ত্রী’র ক্ষমতাবলেই শিক্ষা দপ্তরের নানা পদে কর্মরত। আর এখান থেকেই সম্ভবত দুর্নীতির মূল সূত্রের খোঁজ পান ইডি, সিবিআই তদন্তকারীরা। যে জাল এখন গড়িয়েছে বহুদূর।   

 

পার্থ চট্টোপাধ্যায়: রাজ্যের শাসকদলের অতি চেনা মুখ। বিধানসভা থেকে শিল্প সম্মেলন, দলের পার্টি অফিস থেকে শিক্ষাদপ্তর, একটা সময়ে তাঁর উপস্থিতি ছিল মুখ্য। আর সেই সময়েই কোন চোরাপথে ফাঁদ পেতেছিল বিপদ, টেরও পাননি। যখন পেলেন, বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন দেদার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের (Partha Chatterjee) বিরুদ্ধে। চাকরির পরীক্ষায় স্বজনপোষণ আর টাকার বিনিময়ে ‘অযোগ্য’ প্রার্থীকে ‘যোগ্য’ করে তোলা – কোন বেআইনি কাজটাই না হয়েছে পার্থর আমলে? অন্তত অভিযোগ তেমনই। আর রাজনীতিতে অভিযোগ মানেই ইমেজে দাগ। ফলে আইনি প্রমাণের দীর্ঘ পথে না হেঁটেও যেন অলিখিতভাবে ‘দোষী’র তকমা পেয়ে গিয়েছেন তিনি। ইডির (ED) হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মন্ত্রিত্বের চেয়ারটা নেই। দল তাঁকে ত্যাগ করেছে, কেড়ে নিয়েছে তৃণমূলের মহাসচিবের পদ। পাশে থাকার মতো কেউ নেই। সত্তর ছুঁই ছুঁই বহু পরিচিত অসুস্থ পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন একলা দিন কাটান প্রেসিডেন্সি জেলে চার দেওয়ালের মধ্যে। বেরনো বলতে আদালতে রুটিন হাজিরা। ‘দুর্নীতি’র নাগপাশ থেকে কবে মুক্তি মিলবে, জানা নেই।

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়: কে জানত, এ শহরের বুকে এত টাকা লুকিয়ে থাকবে অভিজাত আবাসনের কুঠুরিতে? এদিক টালিগঞ্জ তো ওদিকে বেলঘরিয়া। সাধারণ এক মডেলের আপাত সাধারণ ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার কোটি কোটি টাকা গুনতে আনতে হল মেশিন! ঘরে কার্যত টাকার পাহাড়। কার ঘরে? নাম তার অর্পিতা মুখোপাধ্যায় (Arpita Mukherjee)। শোনা যায়, বেলঘরিয়ার দেওয়ানপাড়ার মেয়ে অর্পিতা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘বান্ধবী’। নাকতলা উদয়ন সংঘের পুজোর মুখ, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়ার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি মডেল-অভিনেত্রীকে। বেলঘরিয়ার বাড়ি, টালিগঞ্জের ফ্ল্যাট সব জায়গায় টাকা আর টাকা। মেশিনের গণনায় ৮০ কোটি পেরিয়ে যায়। সেইসঙ্গে তাল তাল সোনা। হার, কাঁকন, বালা, চেন, সোনার বাট, সোনার ঘড়ি নিয়ে তার আর্থিক পরিমাণ সাড়ে চার কোটি টাকা। সেসব স্বর্ণভাণ্ডার এখন ইডির জিম্মায়। আর অর্পিতার উচ্চাকাঙ্খা এখন বন্দি আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারে।

[আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ২০২২: রাজ্য রাজনীতিতে কেউ রাজা, কেউ ফকির, বছরভর চর্চিত ৮ চরিত্র]

অনুব্রত মণ্ডল: নামেই কাঁপে বীরভূমের মাটি। সিপিএম আমলের একরোখা, প্রতিবাদী কেষ্ট কালক্রমে শাসকদলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতায় পরিণত হয়েছেন। অনুব্রত মণ্ডলের (Anubrata Mandal) উত্থান চমকপ্রদ, তবে তারই তলে তলে শেষের সেদিনের সূচনাও হচ্ছিল। সম্পদের নেশায় মদমত্ত তৃণমূলের জেলা সভাপতি নিজে তা টেরও পাননি। নিজের হাতে লালমাটিতে ঘাসফুল ফোটানোর কাণ্ডারি অনুগামীদেরও কেরিয়ার গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্বভার একার কাঁধে নিয়ে ফেলেছিলেন। যেমন কড়া, তেমন নরম। কখনও ‘গুড়-বাতাসা’, কখনও ‘চড়াম চড়াম’ দাওয়াই দেওয়া কেষ্ট মণ্ডলের বিরুদ্ধে হাজারও মামলা। কিন্তু সেসবে তাঁর প্রতাপ কমেনি। তাঁকে প্যাঁচে ফেলল গরু! আগস্টের ১১ তারিখ গরু পাচার মামলায় অভিযুক্ত সন্দেহে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। ধরা পড়ে তাঁর নিরাপত্তারক্ষী সায়গল হোসেন। দেখা যায়, তাঁরও সম্পত্তি অঢেল। কিন্তু কোনওটা যে বেআইনি, তা প্রমাণ করা ইডির পক্ষে কঠিন। অনুব্রতর গ্রেপ্তার পর্বে তো টুইস্টের শেষ নেই। ইডি তাঁকে জেরার জন্য দিল্লি নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সমস্ত রকম আইনি পথে গিয়েও যখন চূড়ান্ত রক্ষাকবচ মেলেনি, তখন কী এক খেলায় তিনি নিজের অনুকূলে টেনে নেন পরিস্থিতি। দলেরই এক কর্মীর দায়ের করা অভিযোগে পুলিশ হেফাজতে এখানেই রয়ে গেলেন কেষ্ট।

ছবি: প্রতীকী

মানিক ভট্টাচার্য: পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্ত্রিত্বে শিক্ষাদপ্তরের দুর্নীতির জাল যে কত কতদূর বিস্তৃত হয়েছিল, তা বোঝা যায় একে একে কর্তাব্যক্তির গ্রেপ্তারি পর্বে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। পর্ষদের কাজে তিনি আগেই বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে তৃণমূলের হয়ে লড়াই করে বিধায়ক হন। সেই জোরেই হয়ত ইডি, সিবিআইয়ের সমন পেয়েও বারবার এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। গ্রেপ্তার হওয়ার পর মানিকের কীর্তি দেখে চোখ কপালে দুঁদে গোয়েন্দাদের! তাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ টাকার বিনিময়ে স্কুলশিক্ষকের চাকরি বিক্রি। চোরাপথে সেই টাকা যে কায়দায় তাঁর কাছে পৌঁছত, সেই পদ্ধতি রীতিমত মাথা খাটিয়ে বের করা। লাগেজ ব‌্যাগের ভিতর কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি ফ্ল‌্যাপ ফাইলের কাগজের আড়ালে ফাইল ভরতি বিপুল পরিমাণ টাকা। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি তথা বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যর হাতে এভাবেই তিন বছরে পৌনে ২১ কোটি টাকা পৌঁছে গিয়েছিল। এই চক্রে জড়িত তাঁর ছেলে, শ্যালকও।

শান্তিপ্রসাদ সিনহা: এসএসসি দুর্নীতি এক বৃহৎ ষড়যন্ত্র। একের পর এক কর্তাব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেই ষড়যন্ত্রের খোলস খুলছে পরতে পরতে। আর সেই খোলসের একটি পর এসএসসির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা। যেখানে যা নিয়ম বহির্ভূত কাজ হয়েছে, সবটাই তাঁর জ্ঞাতসারেই হয়েছে বলে অভিযোগ। তিনিও জেলবন্দি।  

[আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ২০২২: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ থেকে দীপিকার বিকিনি, বছরভর বিতর্কে বিনোদুনিয়া]

তালিকা আরও দীর্ঘ। শুধুমাত্র এসএসসি, টেট কেলেঙ্কারিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের হেফাজতে আরও অনেক কর্তাব্যক্তিই। অশোক সাহা, প্রসন্ন রায়, রঞ্জন মাইতি। মামলা চলছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তাঁদের জেলবন্দির মেয়াদ। নতুন বছরে কি তাঁদের শাপমুক্তি থুড়ি জেলমুক্তি ঘটবে? উত্তর লুকিয়ে সম সরণিতে। 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup রাজধানী এক্সপ্রেস toolbarvideo ISL10 toolbarshorts রোববার