বিশ্বদীপ দে: ‘আকাশে তখন ঝড় এসে যাবে বলে থমকিয়ে আছে মেঘ’… রোদ-জলের মেঘলা সকাল গড়িয়ে যখন বেলা, রবিবাসরীয় আকাশে ভেসে এল এক দুঃসংবাদের মেঘ। প্রয়াত তাপস দাস। এই নামে অবশ্য তাঁকে চেনে না আপামর বাঙালি। তিনি সবার কাছেই বাপিদা। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র (Mohiner Ghoraguli) এক অন্যতম মুখ। দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগছিলেন। অবশেষে প্রয়াণ প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর। তিনিই ছিলেন মহীনের ঘোড়াগুলির শেষ ‘ঘোড়া’। ‘দ্য লাস্ট অফ দ্য মহিকানস’। তাঁর বিদায় তাই কোনও ব্যক্তির মৃত্যুমাত্র নয়, একটা যুগের উপরে চিরকালের জন্য পর্দা নেমে আসা।
‘শহরের উষ্ণতম দিনে’র পরশ পেরিয়ে সবে বর্ষা প্রবেশ করেছে বাংলায়। ‘কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ যে ঘোড়াদের ‘কিমাকার ডাইনামোর ’পরে’ চড়ে বেড়াতে দেখেছিলেন জীবনানন্দ তাঁরা আজ ‘সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে’ মঞ্চ থেকে অদৃশ্য। গত শতকের উত্তাল সাতের দশকে যখন ঘোড়াদের দৌড় শুরু হয়েছিল সেই সময়টাও যে বহু আগেই অন্তর্হিত। বাংলা ব্যান্ডও (Bengali rock band) তার স্বর্ণযুগ বুঝি পেরিয়ে নতুন কোনও সন্ধিক্ষণের দিকে এগোচ্ছে। আর ঠিক সেই সময়ই যেন নতুন করে দৌড় শুরু হল মহীনের ঘোড়াগুলির। সমসাময়িকতা পেরিয়ে চিরকালীন হয়ে ওঠার দৌড়।
[আরও পড়ুন: আগেও জলের গভীরে বিপদে পড়েছিল টাইটান! ‘জানতাম একদিন হবেই’, বলছেন প্রাক্তন যাত্রী]
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গান অবশ্য বহুদিনই কাল্ট। কলেজ ক্যান্টিন থেকে ইউটিউব, স্পটিফাইয়ের প্লে লিস্ট, বারবার বেজে ওঠে ‘আমার প্রিয়া কাফে’, ‘মানুষ চেনা যায় কি’, ‘কখন তোমার আসবে টেলিফোনে’র মতো সব গান। কিন্তু পালটানো এই সময়ে সেই গানগুলির যেন নতুন করে জন্মানোর পালা। শিল্পীরা নেই। তবু অদৃশ্য তো নয় মঞ্চ। সেখানে গানগুলি রয়ে গিয়েছে। ‘রানওয়ে জুড়ে পড়ে আছে শুধু কেউ নেই শূন্যতা’। সেই শূন্যতার বুকেই ঘোড়ার খুরের শব্দ।
ছয়ের দশকে দুনিয়া কাঁপিয়েছিল ‘বিটলস’। আর সাতের দশকে এই বাংলার বুকে জন্ম নিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। গৌতম চট্টোপাধ্যায় তাঁর নাকতলার বাড়িতে, যে বাড়িকে তিনি নাম দিয়েছিলেন বেকার হাউস, সেখানেই বাউন্ডুলে বন্ধুদের নিয়ে শুরু করলেন গানের দল। দলের নামকরণ করেছিলেন রঞ্জন ঘোষাল। রাতভর বাজনার দাপটে নাকি আশপাশের বাড়ির লোকজনের ঘুমের দফারফা! সে গান একেবারে নতুন। তার সাউন্ডস্কেপ থেকে কথা, সবেতেই এক অচেনা সময়ের গন্ধ। যে সময় তখনও ভ্রূণ হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে অনাগত কালের গর্ভে। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকার মাশুলও গুনতে হয়েছিল। যা কিছু নতুন তাকে সমালোচনা সহ্য করতেই হয়। ভাগ্যিস, গৌতমরা সেই নিন্দামন্দকে ঝড়ের ভিতরে পাতার মতো উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আপাত ভাবে থমকালেও সে তার নিজস্ব ছন্দে স্পন্দিত হয়ে চলছিল।
[আরও পড়ুন: সভা ভরাতে শুভেন্দুর ভরসা ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচির থিম সং! খোঁচা কুণালের]
নয়ের দশকে নতুন করে ফিরেছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। ততদিনে বাঙালি শ্রোতা নতুন ধরনের গানের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করছিল। ‘ব্যান্ডের গান’ যেন সেই সময়ে নিজস্ব স্বর হয়ে গিয়েছিল। আর সেই সুযোগে ‘আবার বছর কুড়ি পর’, ‘ক্ষ্যাপার গান’, ‘ঝরা সময়ের গান’, ‘মায়া’- পরপর অ্যালবাম প্রকাশ পেল। সেখানে সব যে মহীনের নিজস্ব গান তা নয়। অন্যদের গানও ছিল। সব মিলিয়ে মহীন যেন হয়ে উঠল বাংলা ব্যান্ডের এক অনতিক্রম্য লাইট হাউস। যাকে সামনে রেখে অন্য বাংলা ব্যান্ডগুলি নিজেদের গড়ে তুলতে লাগল।
সময় তার নিজস্ব গতিতে সব কিছু পিছনে রেখে আসে। একে একে বিদায় নিয়েছেন গৌতম ও তাঁর বন্ধুরা। তাপস দাস ছিলেন। শরীরে বাসা বেঁধেছিল কর্কটরোগ। চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক ক্ষমতা তাঁর ছিল না। যদিও পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে চিকিৎসা শুরু হয়। দুস্থ শিল্পীর পাশে দাঁড়ান বাংলার এসময়ের শিল্পীরাও। কিন্তু রবিবারের সকালে থামল লড়াই। রয়ে গেল মহীনের গান। সময় তাকে কোনও অতীতের ব্যালকনিতে ফেলে আসতে পারবে না। এই গান থেকে যাবে। যেখানে ‘সুতোবাঁধা যত লাল আর সাদা ওড়ায় আমার থতমত এই শহরে’, সেখানে অশ্রুঝলমল বিষাদ কিংবা প্রেমিকার হাত ধরে রোদ গনগনে দিনেও মেঘের স্বপ্ন দেখার খোয়াব এঁকে এঁকে মহীনের ঘোড়াগুলি তার চলন জারি রেখে যাবে। মিছিল বা ট্রামের সারির মতোই এই শহরের চিরকালীন এক স্বপ্ন হয়ে।