দুলাল দে: কোটি টাকার সম্পত্তি বললেও কম বলা হবে। আইএফএ-র (Indian Football Association) বাথরুমের ওপরের বাঙ্কার পরিষ্কার করতে গিয়ে বেরিয়ে এল ভারতীয় ফুটবলের (Indian Football) সেই অমূল্য সম্পদ! যা দেখে চোখ ছানাবড়া সকলের। ভারতীয় ফুটবলের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ট্রফি শতাব্দী প্রাচীন ‘ট্রেডস কাপ’ (Trades Cup) এতদিন ধরে সকলের অগোচরে পড়েছিল আইএফএ-তেই! যার ইতিহাস জানলে আইএফএ নয়, ট্রেডস কাপের সঠিক স্থান হওয়া উচিত ভারতীয় জাদুঘরে।
ভারতীয় ফুটবলের প্রাচীনতম ট্রফি ডুরান্ড কাপ (Durand Cup) শুরু হয় ১৮৮৮-তে। তার ঠিক এক বছর পরেই ১৮৮৯-তে ‘ভারতীয় ফুটবলের জনক’ নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী (Nagendra Prasad Sarbadhikari) ইউরোপীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘ট্রেডস অ্যাসোসিয়েশন’ এবং সাহেব দলগুলিকে নিয়ে শুরু করেন ট্রেডস কাপ। যা আইএফএ শিল্ডের (IFA Shield) বহু পুরনো। এমনকী আইএফএ (IFA) প্রতিষ্ঠারও আগের ঘটনা।
[আরও পড়ুন: খেলার মাঝেই আচমকা মাথায় বজ্রপাত! ইন্দোনেশিয়ার ফুটবলারের মাঠেই মৃত্যু, দেখুন ভয়ংকর ভিডিও]
ট্রেডস কাপ শুরুর সেই ঘটনা তখন ইংল্যান্ডের টাইমস পত্রিকাতেও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। মোট ১৩টি ক্লাবকে নিয়ে শুরু হয়েছিল সেই ফুটবল যুদ্ধ। যার মধ্যে ১২টি ক্লাব ইউরোপের। আর একটি মাত্র ভারতীয় ক্লাব ‘শোভাবাজার’ নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর নেতৃত্বে অংশ গ্রহণ করেছিল। ‘ইংলিশম্যান’-এ ১৮৮৯ সালের ১২ জুলাইতে লিখেছে, ট্রেডস কাপে ভারতীয় দলের ম্যাচ দেখতে মাঠে আসবেন স্বয়ং গভর্নর। আর বিদেশি দল, ‘ইস্ট সারে’-কে হারিয়ে নগেন্দ্র প্রসাদের শোভাবাজার ক্লাবের ট্রেডস কাপ জিততে সময় লেগে গিয়েছিল পাক্কা তিন বছর। ১৮৯২-তে ইস্ট সারেকে হারিয়ে নগেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে ট্রেডস কাপ ঘরে তোলে শোভাবাজার ক্লাব। সেই নগেন্দ্র প্রসাদ, যাঁকে ইউরোপীয়ানদের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলতে দেখে স্বামী বিবেকানন্দর (Swami Vivekananda) কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সেই অমৃত বাণী, ‘গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে, তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।’ যে বছর শোভাবাজার ক্লাবকে নিয়ে তিনি ট্রেডস কাপ জিতলেন, ঠিক সেই বছরেই এ আর ব্রাউন, বি আর লিন্ডসে, মিঃ ওয়াটসনকে নিয়ে আইএফএ অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’ তৈরি করলেন নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ‘আইএফএ’ তৈরির পিছনে এই ট্রেডস কাপ জয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
প্রথম বছরে আইএফএ সচিব হন, এ আর ব্রাউন। ঠিক পরের বছরেই ইংল্যান্ডের ‘এলকিন্টন অ্যান্ড কোম্পানী’ দায়িত্ব নিল ঐতিহাসিক শিল্ড তৈরির। যা আইএফএ-কে সরবরাহ করে কলকাতার এজেন্ট ‘ওয়াল্টার লক অ্যান্ড কোং।’ সেই ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড, ইস্ট ইয়ার্কশয়ার-কে হারিয়ে মোহনবাগান জেতে ১৯১১ সালে। তারপর থেকে ট্রেডস কাপ এবং শিল্ড দুটো ট্রফিই পরিচালনা করেছে আইএফএ।
শুধুই ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস নয়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই ট্রেডস কাপ। সেই ঐতিহাসিক ট্রেডস কাপ যে এভাবে আইএফএ বাথরুমের বাঙ্কারে পাওয়া যাবে ভাবতেই পারেননি কেউ। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে আইএফএ সচিবের চেয়ারে বসেছেন বহু ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সেই প্রাচীন ট্রেডস কাপ খুঁজে পাননি কেউ। আইএফএ-তে ভারতীয় ফুটবলের প্রাণপুরুষ নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর মূর্তি রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ট্রেডস কাপের কোনও চিহ্ন ছিল না। সেক্ষেত্রে বর্তমান সচিব অনির্বাণ দত্ত যখন অনেকদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, আইএফএ-র আনাচে-কানাচে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সামগ্রী সংরক্ষণ করার। যেমন অনেক বিখ্যাত ফুটবলারের চুক্তিপত্র সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেরকমই খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে এই ঐতিহাসিক ট্রফি।
যেখানে সেই সময় মাঠের ধারে যেরকম তাঁবু করে ড্রেসিংরুম করা হত, সেই ছবি রয়েছে। বহুদিন আগের এই রূপোর ট্রফিতে বিভিন্ন ক্লাবের নাম থাকলেও এতদিন পরে তা পরিষ্কারভাবে পড়া যাচ্ছে না। উপরে দেখা যাচ্ছে সন হিসেবে লেখা আছে, ১৯১৭। এরকম ঐতিহাসিক ট্রফি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ঠিকভাবে পরিষ্কার করার জন্য সঠিক দোকানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এদিন আইএফএ সচিব বলছিলেন, “চেষ্টা করছি, ঠিকভাবে পরিষ্কার করতে। তাহলে হয়তো ট্রফির গায়ে কী লেখা আছে, তা কিছুটা পড়া সম্ভব হবে। তবে ভারতীয় ফুটবলের এই ঐতিহাসিক ট্রফিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় আইএফএ-তে সঠিক স্থানে রাখা হবে। এই ট্রফি আইএফএ-র সম্পদ।”