মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি সফরের কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে যে, তিনি এখন ভীষণ পরিণত, সচেতন। অনেক বেশি আধুনিক। প্রধানমন্ত্রীকে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমন্ত্রণ জানালেন বিশ্ব শিল্প সম্মেলনে, আমার তো মনে হয়েছে সেটা ‘মাস্টারস্ট্রোক’। নরেন্দ্র মোদির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ‘ব্র্যান্ড ইকুইটি’ তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
১৯৮৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে-অবস্থান থেকে রাজনীতির যাত্রা শুরু করেছিলেন, এখন, এই ২০২১-এর শেষ প্রান্তে, তিনি বহুগুণ পরিশীলিত, পরিণত এবং প্রজ্ঞাবান রাজনেত্রী। মানুষ নিজের সঙ্গেই লড়তে লড়তে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে, অতীতের দুর্বলতা কাটিয়ে উত্তরোত্তর আরও পরিপক্ব, এবং আরও আধুনিক হয়ে উঠতে পারে। ’৮৪ সালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরাস্ত করেছিলেন, তিনি আর এখনকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে সহস্র যোজন দূরত্ব। অবশ্য সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যেও একটা অপরিবর্তনীয় সত্তা থাকে। এক্ষেত্রে সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহজাত মানবিক প্রবৃত্তির ডিএনএ, যা কিনা তাঁর চিরকালীন রাজনৈতিক অভিজ্ঞানকেও সূচিত করে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের দিল্লি-সফরের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে যে, তিনি এখন অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি আধুনিক। এখনকার পরিবর্তিত সমাজে যখন সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট, অল্টারনেট বাস্তবতা তৈরির রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক মানুষ থেকে দিল্লির পার্লামেন্ট- নানা স্তর, নানা উপচার, নানা ব্যঞ্জন- এই সবকিছুর মধ্যে মমতা সমন্বয়সাধন করে এগচ্ছেন। কোনটা সম্ভব নয়, আর কোনটা সম্ভব, সবটাই তিনি বিচার-বিশ্লেষণ করছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখা করলেন কেন? তবে কি বরফ গলছে? তবে কি বিজেপি-তৃণমূলের লড়াই কমে গেল? তাহলে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মসমর্পণ করলেন? তাহলে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভীত-সন্ত্রস্ত সিবিআই আর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট নিয়ে? আমার মনে হচ্ছে, এসবই অনেক বেশি মায়োপিক, ক্ষুদ্র গবাক্ষ দিয়ে দেখা, যে-দেখায় সম্পূর্ণতা নেই।
[আরও পড়ুন: আম নাগরিকের নজরে আদালত সমস্যার সমাধান, নাকি খোদ সমস্যা?]
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতপ্রস্তাবে দ্বিমুখী রণকৌশল নিয়েছেন। যখন অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন জ্যোতি বসু বলেছিলেন- এই সরকার অসভ্য, বর্বরের সরকার। আমি এই সরকারের কোনও প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করব না। অর্থাৎ, অটলবিহারী বাজপেয়ীকে তিনি ‘বয়কট’ করবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং বহুদিন অবধি বয়কট করেওছিলেন। কিন্তু সিপিএমের দলের মধ্যেই প্রশ্ন ওঠে, এটা সঠিক রণকৌশল কি না! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর মতো নেতা উলটে কেন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিছুটা এগতে চেয়েছিলেন। মতাদর্শগত ফারাক থাকতেই পারে, কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধও হতে পারে। সেজন্য দরকার হলে রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে, কিন্তু সেটা হবে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি। কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে সংঘাত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী তথা দুই সরকারের মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ বোঝাপড়া তো জরুরি। কেননা, সংবিধানমাফিক সরকার একটাই, সেখানে কেন্দ্র-রাজ্য আলাদা নয়, আর তারও একটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা আছে। রাজ্যপাল এই দুই সরকারের মধ্যে অন্যতম সেতু। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার নরেন্দ্র মোদিকে এটাই বুঝিয়েছেন যে- মতপার্থক্য বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে থাকবে, নির্বাচনী রাজনীতিতে একপক্ষ মুখর হবে অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে, ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস জিততে চাইবে, এমনকী, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপিকে হটানোর অভিযানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবেন, কিন্তু তাই বলে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, সাংবিধানিক ক্ষেত্রে বিরোধ তিনি চান না। এটা বরাবরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, আমাকে আঘাত করলে আমি পালটা আঘাত হানব। কিন্তু আমাকে যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কাজ করতে দেওয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক বিবাদে যাব না।
কেন্দ্র এবং রাজ্যের সম্পর্ক ভাল হওয়া প্রয়োজন রাজ্যের মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে, রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীকে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমন্ত্রণ জানালেন বিশ্ব শিল্প সম্মেলনে, আমার তো মনে হয়েছে সেটা ‘মাস্টারস্ট্রোক’। প্রধানমন্ত্রী রাজি হয়েছেন আসবেন বলে, সেটাও প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে আর-একটা ‘মাস্টারস্ট্রোক’। সুতরাং, এ এক অসাধারণ সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি। এজন্য যদি মনে করা হয়, বিজেপি তৃণমূলের বিরোধিতার পথ থেকে সরে আসবে, এমনকী, সিবিআই-ইডির বিষয়টাও তারা আর বহাল রাখবে না, রাজ্যপালের মাধ্যমে যে সংঘাতের আবহ আছে তা অচিরেই অবলুপ্ত হয়ে যাবে- তা সঠিক নয়। পুর নির্বাচনে বিজেপির ভূমিকা দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে যে, একটা যুদ্ধং দেহি পরিস্থিতি এখনও আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি কেন্দ্র এবং রাজ্যের সম্পর্কের মধ্যে অচলাবস্থা দূর করাও তো একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে উঠতে পারে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের রাজনৈতিক সফরের আর-একটি দিক হল- বিভিন্ন দল থেকে নানাজনকে আহ্বান জানানো। অনেকে ভাবছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় কংগ্রেসকে ভাঙতে চাইছেন। একথা যাঁরা ভাবছেন বা বলছেন, আমার মনে হচ্ছে তাঁরা ভুল করছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসকে ভাঙতে চাইছেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সুযোগ্য লেফটেন্যান্ট অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এ-কথা জানেন যে, ৪২টা আসনের মধ্যে ৪২টা পেলেও কিন্তু কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির বিকল্প সরকার হয় না। ফলে বিকল্প বিরোধী ঐক্য গড়তে গেলে কংগ্রেসকে প্রয়োজন, সকলেরই তা জানা। বেশ কিছু রাজ্যে এখনও কংগ্রেস বনাম বিজেপি লড়াই চলছে। সেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী হলে তবেই বিরোধী ঐক্য মজবুত হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একটা আঞ্চলিক দল যদি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিকশিত হতে চায়, তার মধ্যে তো কোনও অন্যায় নেই। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ব্যর্থতার জন্য রাজনৈতিক পরিসরে একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। সেই কারণে সেই পরিসরটা দখল করছে তৃণমূল। এখন যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসে আসতে চাইছেন, তাঁদের প্রত্যেককে প্রশান্ত কিশোর ‘ভাঙিয়ে আনছেন’, এমনটা ভাবা বোধহয় একটু অতি-সরলীকরণ হয়ে যায়। যদি গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছুক না হতেন, সুস্মিতা দেব যদি কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসতে ইচ্ছুক না হতেন- তাহলে শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় আর পিকে-র রণকৌশলের জোরে তাঁরা তৃণমূলে চলে আসতেন, এমনটা তো নয়। বরং এসব নেতা বিজেপিতে না গিয়ে যে তৃণমূল কংগ্রেসে এসেছেন, একদিক থেকে কংগ্রেসের পক্ষে তা ভালই। কংগ্রেসের বরং ভাবা উচিত যে, এই নেতা-নেত্রীরা ইউপিএ-র আওতাতেই রইলেন, আর যাই হোক, বিজেপি শিবিরে তো তাঁরা যোগ দেননি। সুতরাং, আগামী দিনে যদি জমিদারি মনোভাব পরিত্যাগ করে কংগ্রেস আঞ্চলিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ইউপিএ-কে পুনরুজ্জীবিত করে, তাহলে এই দল পরিবর্তনকারী নেতারাও কিন্তু ইউপিএ-র মধ্যেই থেকে যাবেন।
এটা তো মানতেই হবে যে, ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আদতে একটা ‘কংগ্রেস সিস্টেম’, রজনী কোঠারি যেমন বলেছিলেন। তবে একথা বলতেই হবে, সেই কংগ্রেস সিস্টেমে এখন অবক্ষয় ধরেছে। এখন এসেছে ‘বিজেপি সিস্টেম’। এখন যদি আঞ্চলিক দলগুলোকে একত্র না করা হয় এবং মাথা তুলে দাঁড়ানোর পরিসর দেওয়া না হয়, তাহলে তা ঠিক হবে না। তৃণমূল কংগ্রেস তাদের সীমাবদ্ধতা জানে বলেই উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কোনও প্রার্থী দিচ্ছে না, কিন্তু গোয়া কিংবা ত্রিপুরা বা মেঘালয়- যেখানে সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, সেখানে দু’-একজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে যদি তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা এগতে পারে- তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে কী করে? আসলে, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিজেদের ইগো বিসর্জন দিতে হবে। শরদ পাওয়ার যেমন বলেছেন, এই সাবেকি জমিদারি মনোভাব পরিত্যাগ করে কংগ্রেসকেও বুঝতে হবে যে, সময় বদলে গিয়েছে। এখন কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলো নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গায় এসেছে। তাদের নেতৃত্বকে যদি স্বীকার না করা হয়, তাহলে কিন্তু নরেন্দ্র মোদি হটাও অভিযান কখনও সফল হতে পারবে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের দিল্লি সফরে অন্তত একটা জিনিস বোঝা গিয়েছে যে, বিভিন্ন রাজ্যে রাজনৈতিক সংগঠন না-ও থাকতে পারে, কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে তিনি হারাতে পারেন- এই সম্ভাবনার ভিত্তিতে দেশজুড়ে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ‘ব্র্যান্ড ইকুইটি’ তৈরি হয়েছে। জাভেদ আখতার বা পবন ভার্মা-র বিরাট কোনও রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক জোর আছে, এ-কথা কেউ বলছে না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প সরকার গঠনের জন্য নাগরিক সমাজ, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমাহারে তৈরি হওয়া সামাজিক মনস্তত্ত্বরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। রাজনীতিতে যাকে ‘সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট’ বলে, তা এক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে। তার ভিত্তিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের একটা বিশ্বাসযোগ্যতাও তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তিনি একজন নেত্রী হিসাবে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, বিকশিত হচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের অতীতের যে সীমাবদ্ধতা, তা পেরিয়ে, বাংলাকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতির পথে হাঁটার চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে তিনি অনেক বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন এবারের দিল্লি সফরে- সে কথা অনস্বীকার্য।