নির্মল ধর: এইতো মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে মনোজদার সল্টলেকের বাড়িতে পর পর কয়েকদিন দিন যেতে হয়েছিল। চলতি বছরটা তপন সিংহের জন্মশতবর্ষ বছর। তাই মানোজদার কাছ থেকে তপনদা সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছিলাম। প্রথমবার বলেছিলেন, "আমি নিজেই লিখব!" কিন্তু প্রথম দিন গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছিলাম - আবেগ ও স্মৃতির ভারে মাথা বেশ ওজনদার হয়েই আছে।
তপন সিংহের ছবি 'বাঞ্ছারামের বাগান' তাঁকে বাংলা সিনেমায় একজন কৃতী অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাঁরই লেখা নাটক 'সাজানো বাগান' থেকে তৈরি ওই ছবি। অশীতিপর বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম তাঁর নিজহাতে গড়া ফুল-ফলের বাগান নিয়ে একেবারেই অবসেসড। নিজের প্রাণের চাইতেও প্রিয় সেই বাগান। অ্যাকাডেমি, মধুসূদন মঞ্চে তিনি ওই বাঞ্ছারামের চরিত্রে যে ভয়ংকর জীবন্ত অভিনয়ের নজির রেখেছিলেন, তপন সিংহের ক্যামেরার সামনেও একইরকম সমান উদ্দীপনা উৎসাহ ও শারীরিক কসরত দিতে এতটুকু ক্লান্ত হননি। তাঁর অভিনয় জীবনের এক মাইলস্টোন এই 'বাঞ্ছারাম'।
সেদিন কথা প্রসঙ্গে বাঞ্ছারামের নামটি আসতেই মনোজ মিত্রের (Manoj Mitra) চোখে দেখছিলাম আনন্দের স্মৃতি চুঁইয়ে বিরহের অশ্রুবিন্দু। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পরই বাস্তবের বাঞ্ঝারামের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করেছিলেন। তাঁর বয়ান ছিল এইরকম ---
এই বাঞ্ছারাম কিন্তু আমার দেখা একজন জলজ্যান্ত মানুষ!' তখন তিনি বয়সে কিশোর। ওপার বাংলায় বাস। সেকথা জানিয়েই বললেন, 'আমার বৃদ্ধা পিসিমা খুব পান খেতেন। আর সেই পান আসত গ্রামেরই এক পানের বরজ থেকে। গুচ্ছ গুচ্ছ পান কে যেন দিয়ে যেত। আমি জানতামও না। একদিন বৃদ্ধা পিসি বললেন, চল মনু, তোকে এক পানের বাগান দেখিয়ে আনি! আমিতো এক পায়ে রাজি। বিকেলের দিকে পিসির হাত ধরে রওনা হলাম পানের বাগান দেখতে। তখনও জানিনা পানের বাগান হয় না, পানের বাগানকে বলে পানের বরজ। সম্ভবত পিসি সেই পানের বাগানের কাছে গিয়ে বাঞ্ছা...বাঞ্ছা বলে চিৎকার করে ডেকেছিলেন। কোথায় বাঞ্ছা? তাঁর কোনও টিকিও দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা পানের বরজ থেকে শুধু একটা মাথা বেরিয়ে পিসির দিকে তাকিয়ে। মাথাটা একজন বুড়ো মানুষের। মাথার চুল থেকে গালের দাড়ি সবই সাদা। কেমন এক ভূতুড়ে মার্কা চেহারা। পিসি বলল, এই দ্যাক কাকে সঙ্গে এনেচি। আমার দাদার ছেলে। তোকে দেখেতো ভয়ে একসা দেকচি। বাপু তুই বরজ থেকে বেরিয়ে আয় আগে।
বৃদ্ধ বাঞ্ছা বেরিয়ে এলেন পুরো শরীর নিয়ে। কুঁজো হয়েই থাকেন, হাঁটেনও কুঁজো হয়ে। পরনে একটা নোংরা খাটো ধুতি, খালি গা। সে এক ভয়ঙ্কর চেহারা! আমি ভয়ে পিসির গায়ে সেঁটে রয়েছি। বাঞ্ছারাম আমার কাছে এসে বললেন, কি খোকা, খুব ভয় পেয়েছ? আমি নির্বাক। তিনি তখন বললেন, দেখ শুধু এই পানের বরজ নয়, ফুল, ফল, আম, কাঁঠালের যেসব গাছ দেখছ, সবই আমার। এই গাছগুলো আমার ছেলেপিলে। আমি এদের জন্ম দিয়েছি, পালন করেছি। এরা আমায় বাবার মতো ভালোবাসে। আমি আর কী বুঝব? ভয়েই ভয়েই মরি আর কি! কাছে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে টেনে নিয়ে চললেন ওঁর ভাঙা কুঁড়ের দিকে। সামনের একটা কাঁঠাল গাছে হাত বাড়িয়ে বেশ মাঝারি সাইজের একটা কাঁঠালের বোঁটা ছাড়িয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, যাও, এটা নিয়ে বাড়ি যাও। ক'দিন বাদে পাকলে পিসিকে বলো ভেঙে দেবে। কাঁঠালটা খেয়ো।
সেই আমার প্রথম দেখা বাঞ্ছরামের সঙ্গে, চোখ ভরে দেখছিলাম তাঁর বাগানের বহর। কোন ফুল নেই সেই বাগানে, কোন সবজি ছিল না সেখানে। পরে পিসির কাছেই শুনেছিলাম প্রতিদিন তিনি পানের বরজ থেকে এক গোছ পান পাঠাতেন পিসির জন্য। একটা পয়সাও নিতেন না। কিন্তু, গ্রামের অন্য কাউকে তিনি বাগানের ধারে কাছে ঘেঁষতেও দিতেন না। ওই পুরো বাগানটাই ছিল তাঁর একার সম্পত্তি। একটু বড় হয়েই চলে আসি এপার বাংলায়। তার পর তো অন্যতর এক জীবন। পড়াশুনো অধ্যাপনা আর নাটক নিয়েই তখন মেতে আছি। পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হলো 'সুন্দরম' নাট্যদল। সেখানে আমরা অন্যের লেখা নাটক নিয়েও অভিনয় করেছি। একসময় দল থেকেই অনুরোধ এল, নতুন নাটক চাই। আমার ঘাড়ে পড়ল লেখার ভার। সম্ভবত সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা শুরু করি 'সাজানো বাগান'। আর তখনই বাগানের মালিক হিসেবে মনের লুকোনো বাঞ্ছারাম বেরিয়ে আসে খাতার পাতায়। বলতে পারেন সেই বৃদ্ধ মালি ও মালিকের প্রতি আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এই নাটক 'সাজানো বাগান'।