সরোজ দরবার: সাতদিন হতে চলল এক ঘণ্টা করে মোটে ঘুমোচ্ছে ছেলেটি। রাতভর উদ্বিগ্ন মানুষের ফোন, মেসেজ। ‘একটা বেডের ব্যবস্থা কি হয়!’ ‘অক্সিজেন স্যাচুরেশন ড্রপ করছে, একটা সিলিন্ডার জোগাড় করে দিতে পারেন, কোথাও পাচ্ছি না।’ সে সব সামলে শেষরাতে চোখ লেগে আসে। আবার কারও উদ্বেগ এসে তন্দ্রা ভাঙায়। এই-ই এখন রুটিন তাঁর। ওদিকে নির্ধারিত সময়ে অফিসে নিজের কাজ শেষ করতে পারছেন না আর এক তরুণ। ‘কোনও ব্যবস্থা কি হয় না!’ এই আর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমশ পেরিয়ে যাচ্ছে ডেডলাইন। বাড়তি কাজ করে ম্যানেজ করতে হচ্ছে তাই। সংবাদমাধ্যমে কর্মরত আর এক তরুণ অফিসের খবরের ব্যস্ততা সামলেই সমান্তরাল ভাবে কাজ করে চলেছেন মানুষের জন্য। দেখতে দেখতে কখন যে রাত গড়িয়ে যায়, ঠাহর করে উঠতে পারছেন না! একইভাবে মাঝরাতে বসে বহুজাতিকের বেঁধে দেওয়া কাজ শেষ করে চলেছেন অপর তরুণ। সারাদিন প্রায় কেটে গিয়েছে অক্সিজেনের খোঁজে। জানেন, সকাল হতে না হতেই খোঁজ বাড়বে। কিন্তু কোম্পানি তা শুনবে কেন! ম্যানেজার তো শুনিয়েই রেখেছেন, বাঙালিরা অনেক কিছু ভুল বোঝে। সে ভুল ভাঙানোর বৃথাশ্রমে নেই ছেলেটি। অফিসের কাজ গুছিয়ে দিয়েই নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
‘ওরা কাজ করে’। শুভেন্দু দেবনাথ, তন্ময় ভট্টাচার্য, সোহম দাস, অর্পণ গুপ্ত, অভিষেক চক্রবর্তী, নির্মাল্য সেনগুপ্ত, অভীক রায়, অমিত দে, শুভঙ্কর দেব, সৃজিতা মান্না, অদ্রিজা ঘটক, সায়ন্তী রায়, পারমিতা চৌধুরী এবং আরও অনেকে। এই কাজের কোনও পারিশ্রমিক নেই। এই কাজে ওঁদের কেউ বাধ্যও করেনি। নিখাদ ভালোবাসার শ্রম। প্রতিবেশী থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত-অপরিচিত বহু মানুষ যখন অসহায়তার কথা জানাচ্ছেন, তখন ওঁরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি। প্রশাসনের কী করার কথা ছিল, কে মানুষের জন্য কাজ করতে কদিন আগেও কান্নাকাটি করছিল, সে তর্কে ওঁরা নেই। তবে, ওঁরাই দেখিয়ে দিয়েছেন, বিপদের দিনে মানুষের জন্য কাজ করতে ওঁরা কেমন মানবশৃঙ্খল তৈরি করতে পারেন। প্রযুক্তি, পরিশ্রম আর সদিচ্ছা- এই-ই ওঁদের সম্বল।
[আরও পড়ুন: ভেঙে গেল মনমোহনের পণ, করোনা আবহে বিদেশি ত্রাণে সবুজ সংকেত ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের]
সারা রাজ্যের নিরিখে দৃশ্যগুলো বিচ্ছিন্ন। তবু বিচ্ছিন্নতা মুছে দিতে এই দৃশ্যগুলোই আজ সহায়। কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গে আচমকা বেসামাল সবকিছু। আচমকা কি? সন্দেহ হয়! আর একটু সতর্কতা কি পালন করা যেত না! ভোটরঙ্গে আর একটু রাশ কি টানা যেত না! প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা। কিন্তু তাতে তো অসহায়তা কমে না। প্রায়ই খবর আসছে, এক পরিবারে প্রায় সকলেই আক্রান্ত। কে কার জন্য দৌড়াবে! যতদিকে ফোন যায় কেবল ‘নেই নেই’ চোখরাঙানি। ডাক্তারবাবুরা ইঞ্জেকশন লিখে দিচ্ছেন, কিন্তু বাজারে তা অমিল। এমনকী শ্বাস নেওয়ার যে অক্সিজেন, তাও মিলছে না কখনও। অক্সিজেন আছে তো সিলিন্ডার নেই। সিলিন্ডার জোগাড় হয় তো বেড নেই। বেড মেলে তো ইঞ্জেকশন নেই। চিকিৎসকরাও যেন অসহায়। আর আক্রান্তের পরিজন তো বিভ্রান্ত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। ঠিক এই ধ্বস্ত সময়েই শহরের তরুণরা জানিয়ে দিচ্ছেন, সমস্ত অব্যবস্থার ভিতরও মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোয় একরকমের শৃঙ্খলা আছে। আর তা কেবল, কথার কথা নয়। গল্পে লেখা কিংবা তাত্ত্বিক বাস্তবতা নয়। একেবারে হাতেকলমে করেই দেখিয়ে দেওয়া যায়। ওঁরা তা দিচ্ছেনও।
নানারকম উদ্যোগের আলো এই মুহূর্তে এসে পড়ছে পীড়িত শহরের বুকে। একাধিক হোয়াটস গ্রুপের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন তরুণরা। সেখানে মুহুর্মুহু শেয়ার হচ্ছে বিভিন্ন তথ্য। দ্রুত তা পৌঁছে যাচ্ছে রোগীর পরিজনদের কাছে। শহর ছাড়িয়ে সেই নেটওয়ার্কের বিস্তার বিভিন্ন জেলাগুলিতেও। এরই মধ্যে অরবিন্দ মূলে, সৌগত রায় বর্ধন পরিকল্পনা করেছেন একটি ওয়েবসাইটের, যেখানে বেড, অক্সিজেন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব তথ্য এক জায়গায় রাখা যায়। রাতারাতি সেটি তৈরি করে ফেলছেন সায়নদীপ ঘটক। সংকট মুহূর্তে এখন তা দিশা দেখাচ্ছে বহুজনকেই। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করেন শ্রেয়সী নাগ চন্দ্র। এই বিপদের দিনে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। একই সিদ্ধান্ত শ্রাবস্তী ঘোষের। আইসোলেশনে আছেন এমন অন্তত পনেরোজনকে প্রত্যেকদিন বাড়ির রান্না খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁর। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুজন এই দুজনের উদ্যোগের খবর ভাগ করে নিচ্ছেন, পৌঁছে দিচ্ছেন যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের কাছে। এরকম বহু উদ্যোগ এই মুহূর্তে যেন শহরের উজ্জ্বল বাতিস্তম্ভ।
[আরও পড়ুন: রাজনীতিবিদরাই ছিল তাঁর ‘ব্রেকফাস্ট’! কেন আজও অতুলনীয় টিএন সেশন?]
মানুষ যদি মানুষের বিপদে পাশে থাকে, তবে সমাজের যে রূপ ফুটে ওঠে তাকেই ‘সমাজলক্ষ্মী’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই তরুণরা অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই সমাজলক্ষ্মীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই-ই আমাদের দেশ। বিভেদ, বিভাজন পিছনে ফেলে যেখানে সবার উপর সত্য কেবল মানুষ। বিপদের দিনে এমন করে ঝাঁপিয়ে পড়া তো এই বাংলার ঐতিহ্য। নতুন সংকটের দিনে তরুণদের এই নিঃস্বার্থ অক্লান্ত পরিশ্রম মনে করিয়ে দিচ্ছে, সময়ের প্রচ্ছদ বদলেছে ঠিকই, বাংলা আজও তার শিকড় ভোলেনি।