কৃশানু মজুমদার: এ যেন সেই ‘দঙ্গল’ সিনেমারই চিত্রনাট্য। গীতা ফোগাট জাতীয় জুনিয়র কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর জাতীয় অ্যাকাডেমিতে যেতেই নিদান দেওয়া হল, তাঁর বাবা মহাবীর সিংহ ফোগাট আর কোচ থাকতে পারবেন না। জাতীয় অ্যাকাডেমির কোচই গীতাকে ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতাগুলির জন্য তৈরি করবেন।
অনেকটা ঠিক সেরকমই বঞ্চনার শিকার টোকিয়ো অলিম্পিক্সগামী (Tokyo Olympics) বাংলার জিমন্যাস্ট প্রণতি নায়েকের (Pranati Nayak) কোচ মিনারা বেগম (Minara Begum)। সব ঠিকঠাক চললে প্রণতির সঙ্গে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন্য দ্য আর্থ’-এ তো যাওয়ার কথা ছিল বাংলার মিনারারই। কিন্তু প্রণতিকে তিলে তিলে গড়ে তোলা বর্ষীয়ান কোচের পরিবর্তে টোকিয়োর বিমানে উঠছেন সাইয়ের নতুন এক কোচ। দেওয়ালিখন সেরকমই। আর তা পড়ার পরে ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল’-কে বিমর্ষ মিনারা বললেন, ‘‘আমাকে বঞ্চিত করা হল।’’
[আরও পড়ুন: করোনা পরিস্থিতিতে AFC কাপের ম্যাচ আয়োজন সম্ভব নয়, জানাল এটিকে মোহনবাগান]
১৬ বছর ধরে পিংলার প্রণতির পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন অভিজ্ঞ কোচ মিনারা। তাঁর কোচিংয়েই স্বপ্নপূরণ হয়েছে প্রণতির। ২০১৯ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ফলাফলের ভিত্তিতে টোকিয়ো যাওয়ার পাসপোর্ট পান প্রণতি। তারও আগে মঙ্গোলিয়ায় সিনিয়র এশিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জেতেন বাংলার মেয়েটি।
সেখানে পদক নেওয়ার পর দেখা গিয়েছিল আবেগঘন মুহূর্ত। প্রণতি দৌড়ে এসে তা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন কোচ মিনারা বেগমের গলায়। সেই যুগলবন্দি এখন ভেঙে গিয়েছে। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতর মিনারা বলছিলেন, ‘‘যে কোনও কোচ এবং খেলোয়াড়ের একটাই স্বপ্ন থাকে। আর তা হল অলিম্পিক। আজ অলিম্পিক যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন এবং সাই আমার প্রতি অবিচার করল। আমাকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না অলিম্পিকে। ১৬ বছর ধরে প্রণতিকে আমি তৈরি করেছি। আমার হাতে গড়া মেয়েটা আন্তর্জাতিক ইভেন্টে পদক জিতল, অলিম্পিকের ছাড়পত্র পেল। এখন আমার জায়গায় যাচ্ছে অন্য কেউ। এতো অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার।’’
কোভিড (Covid-19) অতিমারী ভালই লাল চোখ দেখাচ্ছে গোটা বিশ্বে। শেষ মুহূর্তে মারণভাইরাসের দৌরাত্ম্যকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অলিম্পিক হবে কিনা তা বলবে সময়। কিন্তু তার আগেই অনভিপ্রেত এক বিতর্ক তৈরি হয়ে গেল এদেশের জিমন্যাস্টিক্সে। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে সাইয়ের কোচ ছিলেন মিনারা। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে সাই থেকে অবসর নেন। জাতীয় দল নিয়ে বহুবার আন্তর্জাতিক ইভেন্টে গিয়েছেন তিনি। এহেন মিনারা সাই থেকে অবসর নেওয়ার জন্য কি তাঁকে পাঠানো হচ্ছে না অলিম্পিকে? প্রায় গর্জে উঠলেন বাংলার কোচ। বললেন, ‘‘চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। কোচিং থেকে তো নয়। আর অবসর নেওয়াটাই যদি কারণ হয়, তাহলে আমাকে মঙ্গোলিয়া, জার্মানিতে পাঠানো হল কেন? তখন তো আমি রিটায়ার করে ফেলেছি সাই থেকে। ক্যাম্পও করেছি। ওরা স্থির করেছে অন্য কাউকে পাঠাবে, সেই মতোই আমি বাদ।’’
প্রিয় ছাত্রীকে নিয়ে অলিম্পিকে গেলে পরবর্তীকালে ‘দ্রোণাচার্য’ সম্মানেও ভূষিত হতে পারতেন মিনারা। কিন্তু স্ক্রিপ্ট বদলে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনাও প্রায় শেষ। রাজ্য সরকারের দেওয়া ‘খেলগুরু’ সম্মান পাওয়া মীনারা বলছেন, ‘‘কয়েকমাস প্রশিক্ষণ দিয়েই কি কোনও কোচ একজন জিমন্যাস্টকে অলিম্পিকের জন্য তৈরি করতে পারে? সব ক্রেডিট আমার। ১৬ বছর ধরে পরিশ্রম করেছি। অলিম্পিকে কোচ হিসেবে গেলে দ্রোণাচার্য পুরস্কার পাওয়া যায়। আমি সেই পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বঞ্চিত হবে বাংলা।’’
অন্যায় ভাবে মিনারাকে বঞ্চিত করায় তাঁর বন্ধুরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মিনারার ন্যায়বিচারের জন্য হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপে জিমন্যাস্টিকস সংস্থার প্রেসিডেন্ট সুধীর মিত্তলের কাছে আবেদনও জানানো হয়। “সম্ভব হলে দু’জন কোচকে যাতে অলিম্পিকে পাঠানো যায়, সেই চেষ্টাই করবো,” ধেয়ে আসা আবেদনের জবাবে সুধীর মিত্তল আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন মিনারার বন্ধুদের। প্রণতির ভবিষ্যতের কথা স্মরণে রেখে সবাইকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়ে নিজেই গ্রুপ ত্যাগ করেন জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট।
[আরও পড়ুন: ইতিহাসের পাতায় ঝুলনরা, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম পিংক বল টেস্ট খেলবে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল]
এ দেশের ক্রীড়াজগতে প্রশাসকদের তুঘলকি সিদ্ধান্তের জেরে কোচ ও খেলোয়াড়দের সমস্যায় পড়া এবং সাফল্য না পাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ প্রথা বহু পুরনো। রাজনীতির চোরাস্রোতে খেলাধুলোর পৃথিবীতে অনেক হিসেবই শেষমেশ আর মেলে না। মিনারা বেগমের স্বপ্নও এই স্রোতেই হয়তো ভেসে গেল।