অভিরূপ দাস: “মদের নেশা রামে, সিনেমার নেশা নামে” বলেছিল ‘সিনেমাওয়ালা’। চিৎকার করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন সিনেমা মানেই বড়পর্দা, বিগ স্ক্রিন। কিন্তু সময় বড়ই নিষ্ঠুর। সে আবেগের মর্ম বোঝে না। বোঝে না রূপোলি পর্দার মায়া। সময়ের দাবি অনেক। সেই দাবিতেই ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী মিত্রা সিনেমা হল (Mitra Cinema Hall)। যে সিনেমা হল একদিন উদ্বোধন করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Subhas Chandra Bose)। যেখানে সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray), তপন সিনহার মতো মানুষের যাতায়াত ছিল। সেই মিত্রা সিনেমা হল বন্ধ অনেকদিন আগেই হয়েছিল। এবার বিল্ডিংটিও ভাঙা হবে। জুন মাস থেকে শুরু হবে সেই কাজ। তার জায়গায় গড়ে উঠবে অত্যাধুনিক শপিং মল। হবে মাল্টিপ্লেক্স।
৮৩, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। অর্থাৎ আজকের ব্যস্ত হাতিবাগানের বিধান সরণি। রাস্তার পাশ দিয়ে এখনও গেলে দেখা যাবে মিত্রা সিনেমা হলের নাম। ১৯৩১ সালে যখন নেতাজি সিনেমা হলটির উদ্বোধন করেছিলেন (প্রতি বছর তাঁর জন্মদিনে ছবিতে মালা দেওয়া হত), তখন অবশ্য তাঁর নাম ছিল চিত্রা। মালিক ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ সরকার। ১৯৬৩ সালে নাম পালটে মিত্রা রাখা হয়। তারপর থেকে বহু গোল্ডেন জুবিলির সাক্ষী থেকেছে এই সিনেমা হল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলেছেও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিঙ্গল স্ক্রিনের কদর কমেছে। আর পেরে উঠছিলেন না ৭৫ বছরের মালিক দীপেন্দু কৃষ্ণ মিত্র।
[আরও পড়ুন: পুরনো প্রেম আর দাম্পত্যের মাঝে কি হারিয়ে গেল ‘রেণু’র কাহিনি? পড়ুন ফিল্ম রিভিউ]
২০১৯ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মিত্রা সিনেমা হল। তবে দীপেন্দুবাবুর আশা ছিল কেউ হয়তো দায়িত্ব নিয়ে সিঙ্গল স্ক্রিনের হাল ফেরাবেন। তা হয়নি। “মরার উপর খাঁড়ার ঘা” পড়েছে করোনা (Corona Virus) কালে। যে মিত্রায় এক সময় ৫০ জন কর্মী দিনরাত এক করে কাজ করতেন, সেখানে আজ কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র দুই। কাজ বলতে একবেলায় এসে সিনেমা হলের সামনের জায়গাটুকু ঝাঁট দেওয়া। এমন পরিস্থিতিতে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না বলেই জানান দীপেন্দু কৃষ্ণ মিত্র। বাস্তবের সিনেমাওয়ালার মতে, আগামী দিনে সিঙ্গল স্ক্রিনের অস্তিত্বই থাকবে না। এই পরিণতি হতে হয়তো আরও একটু সময় লাগত। কিন্তু অতিমারী (COVID-19) সময়ের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। যেটা কালকে হওয়ার কথা ছিল, সেটা আজই হয়ে যাচ্ছে। শহরের ইতিকথায় ইট-কাঠ-পাথরের পাঁজরে গড়ে উঠতে চলেছে হালফ্যাশনের শপিং মল। তাতে থাকবে মাল্টিপ্লেক্স। কিন্তু ‘মিত্রা’ থাকবে না। থাকবে না পুরনো সেই ব্যালকনির রেলিং, নিচের চেয়ারে বসে থাকা দর্শকদের চিল চিৎকার। একাকী পর্দার গমগমে আওয়াজ হারিয়ে যাবে ঝাঁ চকচকে মলের চলমান সিঁড়িতে। সভ্যতা এগিয়ে যাবে, রেখে যাবে ‘মিত্রা’র ইতিকথা।