অনির্বাণ চৌধুরী: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘রাজসিংহ’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে ভূমিকায় বলেছিলেন, ইতিহাসনির্ভর কাহিনিতে সব কথা ঐতিহাসিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই একই কথা বলা যেতে পারে আশুতোষ গোয়াড়িকরের ‘মহেঞ্জো দারো’ ছবি নিয়েও। ট্রেলার মুক্তি, গান মুক্তি- এই সবের সময় থেকেই দেশে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে- আশুতোষ তাঁর নতুন ছবিতে প্রবল হারে তথ্যবিকৃতি ঘটিয়েছেন! একশো বার ঠিক কথা! ‘মহেঞ্জো দারো’ হরেক ভুল তথ্যে ভরা! ইতিহাসের সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আশুতোষ যে সংস্কৃতি সেলুলয়েডে তুলে ধরেছেন, তার প্রায় কোনও মিলই নেই! কিন্তু, এভাবে ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তাই তথ্যবিকৃতি বাদ দিয়ে যদি ছবির দিকে তাকাই, কী কী পাওনা হবে? ‘মহেঞ্জো দারো’ আদৌ কি দর্শকের মন জয় করতে পারবে?
এই ছবি আসলে দেখতে হবে যুক্তি-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে। যদি সেটা সেরে ফেলা যায়, তাহলেই নিশ্চিন্ত! কেন না, সব দর্শক ছোটবেলার ইতিহাস বইয়ের পাতায় হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর যে ছবি দেখেছেন, তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চাইবেন সেলুলয়েডের সেটকে। তাই, বিবেচনার দরজায় খিল তুলতেই হবে। তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, আমার মতো যাঁরা ‘মহেঞ্জো দারো’ দেখতে চাইবেন, সেই কাজটা করে ফেলবেন। তার পর তাঁরা কী দেখবেন?
ছবির শুরুতে দেখবেন দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রকৃতি। দেখবেন, রুক্ষ পাথুরে গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা এক নদী। আর, সেই নদীতে তরী বেয়ে চলেছে কয়েকজন সাহসী যুবক। যাদের নেতা সরমন। এই নৌযাত্রার মধ্যে দিয়েই সরমন চরিত্রটিকে বেশ ঠিকঠাক ভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন গোয়াড়িকর। এটা তাঁর চিত্রনাট্যের কৃতিত্ব। কুমির শিকারের দৃশ্য দিয়ে তিনি যেমন বুঝিয়ে দেন কাহিনিতে উত্তেজনার পারদ ধাপে ধাপে চড়বে, তেমনই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন সরমন চরিত্রের মানবিকতা আর বন্ধুবৎসলতার কথা। প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন সরমনের বাহুবল।
সেই সরমন একদিন জেদ করে, কাকার দেওয়া এক বিশেষ সিলমোহর নিয়ে রওনা দেয় মহেঞ্জো দারো নগরের দিকে। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল তার নীলের ব্যবসা। সঙ্গে ছিল বন্ধু হোজো। মহেঞ্জো দারো নগর দেখে সরমন অবাক হয় ঠিকই, কিন্তু অন্য কারণে। এই নগর আর তার সুমহান প্রতীক একশিঙাকে সে যে বার বার স্বপ্নে দেখে! সেই ঘোর কাটিয়ে ওঠার পর পরই সরমনের জীবনে এসে পড়ে অনেকগুলো নতুন মুখ। মহেঞ্জো দারো নগরের প্রধান রক্ষী লোথারকে সে বন্ধু হিসেবে পায়। নগরে পা দেওয়ার শুরুর দিন থেকেই তার সঙ্গে শত্রুতা শুরু হয় অত্যাচারী রাজা মহমের ছেলে মুঞ্জার। এবং, মহেঞ্জো দারো নগরের পূজারী, যাঁর ছবি আমরা একাধিকবার ইতিহাস বইয়ের পাতায় সিলমোহরে দেখেছি, তাঁর মেয়ে চানির সঙ্গে শুরু হয় প্রেমপর্ব। কাহিনির বাকিটুকু তোলা থাক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখার জন্য। ওটা বলিউডের একান্ত নিজস্ব বাঁধা গতে সরমনের প্রতিহিংসা পূরণ এবং মহেঞ্জো দারো ধ্বংসের গল্প- সে কথা ফাঁস করে কোনও লাভ নেই।
মুশকিলটা বাধায় কেবল হাস্যকর তথ্যবিকৃতি! নইলে গোয়াড়িকরের এই ছবিতে উপাদানের অভাব ছিল না। গ্রামজীবন বনাম নগরজীবনের দ্বন্দ্ব খুব সুন্দর ভাবে ছবিতে ধরেছেন তিনি। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো অনেক ঐতিহাসিক বলে থাকেন, ধ্বংসের আগে মহেঞ্জো দারোর সভ্যতায় প্রবেশ করেছিল লোভ এবং কায়েমি ক্ষমতা। সেই দিকটাও চিত্রনাট্যে রাখতে ভোলেননি পরিচালক। দর্শক আশা করবেনই যে তাঁরা ছবিতে খুঁজে পাবেন এই মহান সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ- সেটাও অনবদ্য গ্রাফিক্সে তুলে ধরেছেন গোয়াড়িকর।
এই ছবি আরও একটা ব্যাপার খুব সুন্দর ভাবে লুকিয়ে রাখে চিত্রনাট্যে। ছবির চরিত্রে, ঘটনায় মাঝে মাঝেই এসে পড়ে মহাকাব্যের প্রভাব। সরমন চরিত্রে যেমন স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় রাম এবং কৃষ্ণ- দুজনেরই ছায়া। কৃষ্ণ যেমন গোকুল-বৃন্দাবন থেকে মথুরা নগরে এসে কংসের মৃত্যুর কারণ হন, তিনি মথুরায় এলেন বলেই যে নগরবাসী মুক্তি পায় অত্যাচারী রাজার শাসন থেকে- ‘মহেঞ্জো দারো’ ছবির চিত্রনাট্যেও দেখতে পাওয়া যাবে সেই ঘটনার অনুষঙ্গ। দেখতে পাওয়া যাবে রামের মতো সরমনের সেতুবন্ধন। দেখা যাবে, রাবণের মতোই এক অত্যাচারী রাজাকে যিনি কারও কথায় কান দেন না। এবং, অন্যকে বশ করেন সোনা দিয়ে!
এছাড়া সিনেম্যাটোগ্রাফি তো রয়েছেই। ছবির বেশির ভাগটাই ঘুরপাক খেয়েছে সেটের মধ্যে। কিন্তু, চোখ ক্লান্ত হয়ে ওঠেনি। আর্থ কালারের নানা শেডে মহেঞ্জো দারোর সেট সুন্দর ভাবেই বানিয়েছেন শিল্পীরা। সেই সেটে ক্যামেরার কাজ দেখতে ভাল লাগে।
তবে, এত কিছু ভালর মধ্যে মাঝে মাঝেই তাল কেটে দেয় কয়েকটা ছোটখাটো ব্যাপার। যেমন, ছবি শুরু হওয়ার পরে বেশ কিছুক্ষণ একটা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলতে শোনা যায় সরমন আর তার দলবলকে। একটা সময়ের পর গিয়ে ক্যামেরা স্থির হয়, জুম করে একটি চরিত্রের ঠোঁটে। আচমকাই তখন তার মুখ থেকে সেই ভাষা চলে যায়, শোনা যায় হিন্দি। এরকম একটা জগাখিচুড়ির কোনও প্রয়োজন ছিল না বলেই মনে হয়। তা ছাড়া, পরিচালক এও স্পষ্ট করেননি, ওটা সরমনের গ্রাম আমরির মানুষের ভাষা না কি মহেঞ্জো দারোর ভাষা! নায়িকা যখন গান গায়, তার মুখে শোনা যায় দক্ষিণ ভারতীয় ভাষার মতো কিছু শব্দ। এভাবে কাল্পনিক একটা ভাষাবিধি ছবিতে না রাখলেও চলত! সিন্ধু সভ্যতার মানুষরা নরখাদক পুষত, এও দেখানো অর্থহীন! আর, সিন্ধু নদীর ধারাকে গঙ্গা নাম না দিলেও চলত! ভাষার ব্যাপারটা মেনে নিলেও নদীমাতৃক সভ্যতার জলের ধারা নিয়ে এতটা ছেলেখেলা না করলেই পারতেন গোয়াড়িকর!
তবে, অভিনয়ের গুণে অন্তত একবার হলেও দেখে নেওয়া যায় ‘মহেঞ্জো দারো’। হৃতিক রোশন দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, এমনটা যদিও বলা যাবে না! সরমনকে দেখে মাঝে মাঝেই ‘অগ্নিপথ’-এ হৃতিক অভিনীত বিজয় দীননাথ চৌহানের কথা মনে পড়বে। সরমনের সারল্য দেখে মনে পড়বে ‘কোই মিল গয়া’র রোহিতের কথা। কিন্তু, খুব একটা অসুবিধা হবে না। কেন না, হৃতিক পেশাদার অভিনেতা। তাঁর অভিনয় খারাপ হলেও, প্রত্যাশা পূরণ না করলেও অন্তত হতাশ করে না। এই ছবিতেও সেটাই হয়েছে। মহেঞ্জো দারো-র সমসাময়িক কোনও মানুষকে তাঁর অভিনয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য, চিত্রনাট্যে সিন্ধু সভ্যতার মুখটিই যখন কাল্পনিক, তখন এসব প্রশ্ন তোলাই বৃথা!
নায়ককে বাদ দিলে আলাদা করে মনে দাগ কাটে না প্রায় কোনও চরিত্রই! মহমের ভূমিকায় কবীর বেদি, মুঞ্জার ভূমিকায় অরুণোদয় সিং একেবারেই বলিউডের টিপিক্যাল ভিলেন! সরমনের কাকার ভূমিকায় থাকা নীতীশ ভরদ্বাজ নিতান্তই জড়োসড়ো এক মানুষ। নগররক্ষী লোথারের ভূমিকায় থাকা দিগন্ত হাজারিকা তুলনামূলক ভাবে ভাল; তাঁর অভিনয় আহামরি কিছু না হলেও মনে থেকে যায়। মণীশ চৌধুরিও সিন্ধু সভ্যতার পূজারীর গাম্ভীর্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হন।
তবে, এই এত কিছু ততটাও ভাল নয়ের মধ্যে অবাক করেন নায়িকা পূজা হেগড়ে। বলাই যায়, ছবির নায়িকা নির্বাচনে ভুল করেননি গোয়াড়িকর। তাঁর দরকার ছিল এরকম একটা চেহারা যা কলুষিত নগর সভ্যতায় খোলামেলা হাওয়া হয়ে ধরা দেবে। সেই কাজটা নাচে, অভিনয়ে, সৌন্দর্যে করে উঠতে পেরেছেন পূজা। উচ্চারণটা শুধু আধো-আধো না হলেই ষোল কলা পূর্ণ হত।
আর হতাশ করেছে এই ছবিতে এ আর রহমানের সঙ্গীত। তাঁর মিউজিক স্কোর কোথাও একবারের জন্যও সিন্ধু সভ্যতাকে মনে করিয়ে দেয়নি। বরং, খুব বেশি করে মনে হয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির কথা। মনে হয়েছে, এই সঙ্গীত বড় আধুনিক। তা আমাদের পুরনো সময়ে নিয়ে যায় না।
তাহলে কী করা যায়? মহেঞ্জো দারো দেখবেন? না কি দেখবেন না?
আমি বলি কী, প্রেক্ষাগৃহে চলেই যান! একবার অন্তত ছবিটা দেখতে খারাপ লাগবে না। শুধু খুব বেশি কিছু আশা করে যাবেন না!
ছবি: মহেঞ্জো দারো
পরিচালনা, কাহিনি ও চিত্রনাট্য: আশুতোষ গোয়াড়িকর
প্রযোজনা: সিদ্ধার্থ রায় কাপুর
সঙ্গীত: এ আর রহমান
সিনেম্যাটোগ্রাফি: সি কে মুরলীধরন
অভিনয়: হৃতিক রোশন, পূজা হেগড়ে, কবীর বেদি, অরুণোদয় সিং, নীতিশ ভরদ্বাজ প্রমুখ
২.৫/৫
The post ‘মহেঞ্জো দারো’ না দেখলে কী কী হারাবেন? appeared first on Sangbad Pratidin.