সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে এসেছে ‘মিসেস চ্যাটার্জী ভার্সাস নরওয়ে’র ট্রেলার। আর তাতেই ফিরেছে পুরনো স্মৃতি। যে স্মৃতি ‘সংবাদ প্রতিদিন’ ও ‘চ্যানেল টেন’-এর হার না মানা মানসিকতার। নরওয়েতে প্রবাসী বাঙালি দম্পতির দুই শিশুসন্তান ছিনতাইয়ের তীব্র প্রতিবাদ করেছিল এই দুই সংবাদমাধ্যম। তার প্রভাব কলকাতাতেও দেখা গিয়েছিল।
‘সংবাদ প্রতিদিন’ ও ‘চ্যানেল টেন’-এর ডাকে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রসদন থেকে রবীন্দ্র সরোবর পর্যন্ত মৌন মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ৷ হেঁটেছিলেন সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভনসুন্দর বসুরাও। কী লেখা হয়েছিল সেদিন? ফিরে দেখা যাক,
স্টাফ রিপোর্টার: মিছিল নগরী সোমবার দুপুরে সাক্ষী থাকল অন্যরকম প্রতিবাদ মিছিলের। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে পথে নামলেন হাজার হাজার মানুষ। নরওয়ে থেকে কলকাতার দূরত্ব কয়েক হাজার মাইল ৷ কিন্তু ভৌগোলিক এই দূরত্ব মুছে গেল সহমর্মিতার আবেগে। নরওয়েতে প্রবাসী বাঙালি দম্পতির দুই শিশুসন্তান ছিনতাইয়ের প্রতিবাদে পথে নেমে আবার বুঝিয়ে দিল কলকাতা, এ শহর প্রতিবাদ করতে জানে। তবে, চিত্কৃত প্রতিবাদ নয়, মৌনতার শক্তিতে আলাদা মাত্রা পেয়েছিল এদিনের মিছিল।
‘সংবাদ প্রতিদিন’ ও ‘চ্যানেল ১০’-এর ডাকে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রসদন থেকে রবীন্দ্র সরোবর পর্যন্ত আয়োজিত এই মৌন মিছিলে পা মিলিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ ৷ মিছিল যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে মানুষের সংখ্যা ৷ দু’পাশের বাড়ি অফিস থেকে অগণিত মানুষ হাত নেড়ে সমর্থন জানিয়েছেন ৷ মৌন মিছিলে নীরব সমর্থন ৷ মিছিলের শেষে লেক রোডে নরওয়ে কনসুলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের হাতে দু’টি স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয়৷ অনুরূপ-সাগরিকার পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া স্মারকলিপিতে অভিজ্ঞান ও ঐশ্বর্য, এই দুই শিশুকে নিঃশর্তভাবে তাদের বাবা-মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে ৷ অপর একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয় ‘ইন্ডিয়াস স্মাইল’ নামে একটি স্বেচছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে। ওই স্মারকলিপিতে অভিজ্ঞান ও ঐশ্বর্য বর্তমানে কোথায়, কীভাবে রাখা হয়েছে, তাদের কী কী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে এসব বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে।
স্বেচছাসেবী সংস্থার পক্ষ। থেকে গান্ধীগিরি দেখিয়ে একটি ফুলগাছ সমেত টব কনসুলেটের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ৷ স্মারকলিপি পেশের পর সাগরিকার বাবা মনোতোষ চক্রবর্তী বলেন, দাবি মানা না হলে দিল্লিতে নরওয়ে দূতাবাস ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়া হবে ৷ এক্সাইড মোড় থেকে শুরু হয়ে হাজরা মোড় হয়ে রবীন্দ্র সরোবর ঘুরে লেক রোডে নরওয়ে কনসুলেটে শেষ হয় মিছিল ৷ দুপুর একটায় যখন মিছিল শুরু হয়, তখনই মনোতোষ চক্রবর্তী ও শিখা চক্রবর্তী, সাগরিকার বাবা ও মায়ের কান্নাভেজা গলা বেঁধে দেয় মিছিলের সুর ৷
দুই অসহায় প্রবীণ জানান, অন্য কোনও দাবি নয়, ঘরের শিশুরা ঘরে ফিরুক, এটাই একমাত্র দাবি তাঁদের। পোস্টার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড হাতে হাজার হাজার মানুষ এগোতে থাকে। ফেস্টুন পোস্টারে লেখা ছিল, ‘অভিজ্ঞান ও ঐশ্বর্যকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দাও’, ‘দুই ভারতীয় শিশুকে নরওয়ে থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক’ প্রভৃতি ৷ মিছিলের সামনে একজন মহিলার হাতে ধরা ছিল একটি টব, তাতে একটি ফুলগাছ। পরে এই টবটিই সৌহার্দ্যের স্মারক হিসাবে নরওয়ে কনসুলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৷ প্রায় দেড়ঘণ্টা পথ চলা এই প্রতিবাদী মিছিলে অনুরূপ-সাগরিকার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি তো ছিলেনই। ছিলেন সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভনসুন্দর বসু, ঐশ্বর্যা দত্ত প্রমুখ সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও ৷
স্মারকলিপি গ্রহণ করে নরওয়ে কনসুলেটের আধিকারিক জানিয়েছেন, স্মারকলিপি দু’টি দিল্লিতে নরওয়ে হাইকমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তার পর এবিষয়ে হাইকমিশনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে অনুরূপ-সাগরিকার পরিবারকে। তবে সিদ্ধান্ত জানানোর ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করতে রাজি হননি ওই আধিকারিক।
[আরও পড়ুন: ‘আপনার মতো ভগবান পাশে ছিল বলে…’, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে ‘অসহায়’ মা-মেয়ে]
সেই সময় চ্যানেল ১০-এর আউটপুট এডিটর ছিলেন প্রসেনজিৎ বক্সী। ‘মিসেস চ্যাটার্জী ভার্সাস নরওয়ে’ সিনেমার নামটি দেখেই তাঁর কৌতূহল হয়েছিল। দেখলেন যে ভেবেছিলেন ঠিক তাই। এ সাগরিকারই গল্প। অতীতের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমাদের লড়াইটাই আজ সিনেমার পর্দায়। সেটা ২০১১ সালের কোন একটি সন্ধ্যা। টেলিভিশন চ্যানেল এর প্রবল কাজের চাপের সময়। সংস্থার CEO কুণাল ঘোষ এর অনুরোধ… দেখো তো এটা কিছু করা যায় কিনা। এক অসহায় বাবা আর এক NGO কর্মী রাজীব সরকার। বাবার কাতর অনুরোধ আর রাজীবের ব্যাখ্যা শুনে মনে হল করা যেতে পারে। কিন্তু কীভাবে? শিশুদের দাদুর দাবি কতটা সত্যি? আমাদের চেষ্টা কতটা দূর নিয়ে যেতে পারে বিষয়টা?
সময় বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে। সাগরিকার স্বামী অনুরূপ এর সঙ্গে কথা হল। ওরাও লাইভে আসতে প্রস্তুত, ওরা তো তখন মরিয়া। আমিও কমপিউটার খুলে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করে বিষয়টা বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি রাত হয়ে গেছে, সহকর্মীরা সব প্রায় বাড়ির পথে। অথচ নরওয়ের শহর থেকে বাংলার দর্শকদের জন্যে লাইভ করতে হবে। সহকর্মী সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বাড়ির পথে অর্ধেক রাস্তা। ফিরে এল। শুরু হলো প্রযুক্তিগত প্রচেষ্টা। শেষ পর্যন্ত লাইভ হল।”
এরপরের কয়েকটা দিন ছিল লড়াইয়ের। কুণাল ঘোষের বুদ্ধিতেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ দেখানো হয়েছিল। জানান প্রসেনজিৎ বক্সী। সাগরিকা যেন সন্তানদের নিয়ে ভাল থাকেন। রানি ও অনির্বাণের সিনেমাও যেন সফল হয় সেই কামনা করেছেন তিনি। এরপরই বলেন, “আমাদের পাওনা কোথায় জানেন? ঘটনার পরে একদিন মধ্যরাতে লেকটাউনে আইসক্রিম খাওয়ার শখ হয়েছিল আমার আর কুণালের। খেলাম, টাকা দিতে গেলাম। দোকানের বন্ধু বললেন যেভাবে আপনারা বাচ্চাদের ফিরিয়ে এনেছেন, এটা না হয় আমার পক্ষ থেকে আপনাদের শুভেচ্ছা।”
অন্তর থেকে বিষয়টা অনুভব করেছিলেন সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই এই নৃশংস বিষয়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন ছবির মাধ্যমে সেই বাস্তব কাহিনি মানুষ দেখবেন, তা অবশ্যই তাঁদের মন ছুঁয়ে যাবে। তাতেই খুশি তিনি। শোনা যায়, এখন সাগরিকা সন্তানদের নিয়ে রয়েছেন পুণেতে। যোগাযোগ নেই, কিন্তু লড়াইয়ের কাহিনি তো আছে। আর তা এভাবেই বেঁচে থাকবে ক্যামেরা ও কলমের জোরে।