shono
Advertisement

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর নেপথ্যে ইন্দিরা! কী হয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর আগে শেষ ২৪ ঘণ্টায়?

Published By: Biswadip DeyPosted: 09:33 PM Mar 16, 2024Updated: 09:42 PM Mar 16, 2024

লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর 'মৃত্যুরহস্য' থেকে ইন্দিরা গান্ধীর 'জেলযাত্রা', জ্যোতি বসুর 'ঐতিহাসিক ভুল' থেকে মোদির 'রাজধর্ম পালন'- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।

Advertisement

স্থান: সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ। তারিখ: ১১ জানুয়ারি ১৯৬৬। সময়: রাত একটা কুড়ি। এত গভীর রাতে আচমকাই দরজায় জোরে জোরে খট খট শব্দ শুনতে পেলেন জে এন সহায়। দরজা খুলে দেখলেন ওপারে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী! তিনি জানালেন তাঁর বুকে ব্যথা হচ্ছে। সহায় ছিলেন লালবাহাদুরের ব্যক্তিগত সচিব। চোখের সামনে দেখেছিলেন দেড়টা বাজতে না বাজতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শাস্ত্রীজি।

পরদিন সকালে কুয়াশাঘন বিমানবন্দরে এসে পৌঁছল তাঁর মৃতদেহ। উপস্থিত সকলেরই চোখে পড়ল প্রৌঢ় মানুষটির সমস্ত শরীর নীল হয়ে গিয়েছে! প্রশ্ন উঠতে শুরু করল, তবে কি হার্ট অ্যাটাক নয়, বিষপ্রয়োগে খুন করা হয়েছে লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে? আজও রহস্যে ঢাকা মানুষটির মৃত্যু।

[আরও পড়ুন: বাংলায় ৭ দফায় নির্বাচন, কোন লোকসভা কেন্দ্রে কবে ভোট? রইল পূর্ণাঙ্গ তালিকা]

কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল শাস্ত্রীজির (Lal Bahadur Shastri)? যদি সত্যিই তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকে, তাহলে কারা রয়েছে এর পিছনে? বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। এমনকী ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন কেউ কেউ! এবিষয়ে কথা বলতে গেলে আগে সময়টাকে বোঝা প্রয়োজন। গত শতকের ছয়ের দশক। সদ্য মৃত্যু হয়েছে জওহরলাল নেহরুর। ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। যদিও তিনি চেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী কিংবা জয়প্রকাশ নারায়ণের মধ্য়ে কাউকে বাছা হোক। তবে তাঁরা নন, এমনকী মোরারজি দেশাই, যিনি সেই সময় প্রধানমন্ত্রিত্ব পেতে নাকি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, তিনিও নন। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। কিন্তু মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই প্রয়াণ ঘটল তাঁর। তাও বিদেশের মাটিতে!

মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তাঁকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লড়তে হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত জয়ী হয় নয়াদিল্লিই। আর দুই দেশের মধ্যে সন্ধি প্রস্তাব স্বাক্ষরিত হওয়ার স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয় রাশিয়া। আসলে কোনও নিরপেক্ষ দেশেই এই চুক্তি হওয়ার বিষয়টি আগেই স্থির হয়েছিল। অগত্যা ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাশিয়ায় (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) উপস্থিত হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাক রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আয়ুব খান। বিকেলের মধ্যে চুক্তি সইও হয়ে যায়। সন্ধ্যায় এক পার্টিতে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা যায় দুই রাষ্ট্রনেতাকে। তখনও পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। সেই সময় কার পক্ষেই বা কল্পনাও করা সম্ভব, আর কয়েক ঘণ্টার আয়ু অবশিষ্ট রয়েছে লালবাহাদুরের!

[আরও পড়ুন: প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার পরিস্থিতি কেমন? চিনের মোকাবিলায় কতটা তৈরি ফৌজ? জানালেন সেনাপ্রধান]

সেদিন রাতে কী খেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী? যেহেতু পার্টিতে সামান্য খাবার খেয়েছিলেন তাই পরে আর বিশেষ কিছু খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না শাস্ত্রীজির। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি পালংশাকের তরকারি খেয়েছিলেন। পরে খান একগ্লাস দুধ। আর এই রান্নার দায়িত্বে ছিলেন মহম্মদ জান ও এক রুশ রাঁধুনি। আশ্চর্যের বিষয় হল, তার আগের কুড়ি বছর শাস্ত্রীকে খাবার রেঁধে দিতেন রাম নাথ। সেই দুই দশকের সঙ্গী সেদিন রান্নার দায়িত্ব পাননি! রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা বিষয়টি। আজও।

এর পর নাকি লালবাহাদুরের সঙ্গে ফোনে কথা হয় তাঁর পরিবারের সঙ্গে। কথা হয় দিল্লি থেকে পিএমও-র দপ্তর থেকে ফোন করা তাঁর এক ব্যক্তিগত সচিব বিএস ভেঙ্কটরমনের সঙ্গে। দুই ক্ষেত্রেই নাকি প্রবীণ নেতা জানতে চেয়েছিলেন তাসখন্দের এই চুক্তিকে দেশবাসী কীভাবে নিচ্ছিলেন। জবাব পেয়েছিলেন একই। গোটা দেশ এই বিষয়ে লালবাহাদুরের সিদ্ধান্তের পাশেই রয়েছে। শুনে কিছুটা আশ্বস্তও হন তিনি। এভাবেই রাত ঘনায়। আর তার পর আচমকাই অসুস্থ বোধ করতে থাকেন তিনি। যে কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। রাশিয়ার এক চিকিৎসক দ্রুত তাঁকে দেখতে আসেন। আর তার পর তিনি চিকিৎসা শুরু করতে না করতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। শোনা যায় তিনি নাকি বার বার ইঙ্গিত করছিলেন তাঁর বিছানার পাশে রাখা জলের ফ্লাস্কটির দিকে। তাহলে কি সেই ফ্লাস্কে বিষ মেশানো হয়েছিল? আবার দুধ খাওয়ার পর থেকেই অস্বস্তি শুরুর কথাও জানা যায়। এই দুইয়ের মধ্যেই কোনওটায় বিষ মেশানো ছিল, এমনই গুঞ্জন।

কিন্তু শাস্ত্রীকে যদি খুনই করা হয়ে থাকে, তাহলে এর পিছনে কাদের হাত থাকতে পারে? এই বিষয়ে অনেকেই ইন্দিরা গান্ধীর কথা বলেন! প্রধানমন্ত্রীর কুরসির দিকে তাকিয়ে তিনিই ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এমন যুক্তি কেউ কেউ দেখান। কিন্তু এই যুক্তি ধোপে টেকে না। কেননা তখনও ইন্দিরা বিরাট প্রভাবশালী নেত্রী হয়ে উঠতে পারেননি। নেহরু-কন্যা হওয়া সত্ত্বেও 'গুঙ্গি গুড়িয়া' অর্থাৎ স্বল্পবাক এক নেত্রী হিসেবেই তখন তাঁর পরিচয়। সেই সময়ের একেবারেই গুরুত্বহীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক ছিল তাঁর অধীনে। তাছাড়া খোদ শাস্ত্রীজি চাইতেন ইন্দিরার মতো তরুণ নেত্রীরা দেশের দায়ভার সামলান। কাজেই তিনি এমন ঘৃণ্য চক্রান্তের কথা ভাববেন, সেই সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য।

বরং সন্দেহের তির বেশ গাঢ় দুদিকে। যদিও কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। তবে তৎকালীন সোভিয়েত ও আমেরিকা, দুই দেশেরই কিন্তু 'মোটিফ' ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও ভারতের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বই ছিল। কিন্তু কূটনৈতিক দিক থেকে সেই সময় ইসলামাবাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। এমনকী যুদ্ধ চলাকালীন ভারতকে সরে দাঁড়ানোর আর্জিও জানিয়েছিলেন সেই সময়ের সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোজিগিন। কিন্তু লালবাহাদুর যুদ্ধ থামাননি। শেষপর্যন্ত ভারতই জয়ী হয় লড়াইয়ে। এই বিষয়টাকে কি ভালোভাবে মেনে নিয়েছিল সোভিয়েত? এই দিকটি মাথায় রাখলে মনে হতেই পারে হয়তো তারাই এর পিছনে থাকতে পারে।

তবে সবচেয়ে বেশি করে উঠে আসে সিআইএ-র কথা। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার অপারেশনস ডিরেক্টর রবার্ট ক্রাউলি 'কনভার্সেশন উইথ দ্য ক্রো' বইয়ে দাবি করেছিলেন, শাস্ত্রীর মৃত্যু আসলে খুন। এবং এই চক্রান্ত করেছিল সিআইএ-ই! কিন্তু কেন তাঁরা শাস্ত্রীকে হত্যা করতে চাইবেন? এর পিছনে অনেকেই মনে করিয়ে দেন 'ঠান্ডা যুদ্ধে'র কথা। সোভিয়েতের মাটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হলে অস্বস্তিতে পড়তে হবে তাদের। এর পাশাপাশি আরও একটা বিষয় রয়েছে। আমেরিকা চায়নি ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়ে উঠুক। অনেকেরই মতে, সেই সময় ভারতের বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলেন। ফলে অচিরেই পারমাণবিক অস্ত্র হাতে চলে আসতে পারে তাদের। এই আশঙ্কা থেকেই কেবল শাস্ত্রীই নয়, বহু ভারতীয় বিজ্ঞানীকেও বাকি 'খুন' করেছিল সিআইএ! এমন 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' কিন্তু রয়েছে। কিন্তু এই সব রহস্যের আজও সমাধান হয়নি। কোন এক অবোধ্য কারণে বহু প্রশ্নের উত্তরই মেলেনি। কেন সেই সন্দেহজনক ফ্লাস্কে বিষ রয়েছে কিনা পরীক্ষা করা হয়নি? দুই রাঁধুনি মহম্মদ জান ও এক রুশ ব্যক্তিকে নাকি গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু তার পর তাঁদের কী হয়েছিল জানা যায় না? এমনই নানা প্রশ্নের কুয়াশায় আজও ঢাকা লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুরহস্য।

আর একটা কথা শোনা যায়। পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময় নাকি প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীজি দাবি করেছিলেন, তিনি এক অদ্ভুত খবর পেয়েছেন। যা জানলে গোটা দেশ অবাক হয়ে যাবে। এও এক রহস্যে মোড়া বিষয়, যার কোনও কিনারা হয়নি। এর সঙ্গেও কি ছিল শাস্ত্রীর মৃত্যুর কোনও যোগ? উত্তর আজও মেলেনি। কেটে গিয়েছে ছয় দশক।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement