কৃশানু মজুমদার ও মণিশংকর চৌধুরী: ইংল্যান্ড-ইরান (England vs Iran) ম্যাচে ইরানি ফুটবলাররা জাতীয় সংগীত গাননি। এতে দুনিয়াব্যাপী ধারণা ছড়িয়েছে যে জাতীয় দলের ফুটবলাররা ইরানের হিজাববিরোধী আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানাতেই এমন পদক্ষেপ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আলিরেজাদের এহেন কীর্তি নিয়ে জোর চর্চা হয়েছে। তাঁদের প্রশংসা করা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু ইরানে ফোন করে যা জানা গেল তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। গতকাল ইংল্যান্ডের কাছে হাফ ডজন গোলে বিধ্বস্ত হয়েছে ইরান। এমন লজ্জাজনক হারে শোকে মূহ্যমান হওয়ারই কথা দেশের ফুটবলপ্রেমীদের। কিন্তু ইরানের মানুষ এই হারে দারুণ খুশি। তাঁরা বলছেন, জাতীয় সংগীত না গেয়ে ফুটবলাররা ‘নাটক’ করেছেন।
বিশ্বফুটবলমঞ্চে জাতীয় দলের বিপর্যয়ের খবর পেয়ে দেশের মানুষ আনন্দিত হচ্ছেন, পুলকিত হচ্ছেন এমনটা শুনলে অবাক হওয়ারই কথা। কিন্তু ইরানের ফুটবলার মিলাদ সোলেইমানি (Milad Sheykhi Soleimani) সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে ইজেহ শহর থেকে যা বললেন তা শুনলে বিস্মিতই হতে হবে। উল্লেখ্য গত সপ্তাহে ইজে শহরের বাজারে গুলি চালায় বন্দুকবাজ। মারা যায় পাঁচ জন। ঢাকা আবাহনীর হয়ে মোহনবাগানের (Mohun Bagan) বিরুদ্ধে খেলে যাওয়া ইরানি ডিফেন্ডার মিলাদ বলছেন, ”কাল ইংল্যান্ডের কাছে ইরান হেরে যাওয়ায় দেশের মানুষ দারুণ খুশি হয়েছেন। কারণ জাতীয় দলের ফুটবলাররা হিজাববিরোধী আন্দোলনকে মোটেও সমর্থন করেননি। মানুষের পাশে দাঁড়াননি। ব্যক্তিগত লাভ এবং নিজেদের সুযোগ সুবিধার জন্য ইরানের প্রেসিডেন্টের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়েছিলেন চেসমিরা। কাতারে প্রথম ম্যাচে জাতীয় সংগীত না গাওয়াটা নাটক ছিল।” উল্লেখ্য মিলাদ ঢাকা আবাহনী ছেড়ে এখন ইরানের দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলেন। ইরান থেকেই দেশের ছবিটা তুলে ধরছিলেন।
[আরও পড়ুন: ‘রোনাল্ডো হ্যান্ডসাম কিন্তু আমার ক্রাশ মেসিই’, বলছেন ফুটবল জ্বরে কাঁপতে থাকা জাহানারা]
গত ১৪ নভেম্বর কাতারে যাওয়ার আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন চেসমি, তারেমিরা। ছবিতে দেখা যায় রাইসির সামনে মাথা নীচু করে কুর্নিশ জানাচ্ছেন ইরান জাতীয় দলের ডিফেন্সিভ মিডিফল্ডার রুজবে চেসমি। আর এই ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে গোটা দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়। দেশের সাধারণ মানুষ ফুটবলারদের ভর্ৎসনা করতে থাকেন। জনরোষ পুঞ্জীভূত হতে থাকে ফুটবল দলের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া, দেশের মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন জাতীয় দলের ফুটবলাররা। এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। মিলাদ বলছেন, ”গোটা দেশে যখন বিপ্লবের আগুন জ্বলছে, তখন ফুটবলাররা একটি শব্দও খরচ করেননি। শুধুমাত্র চেসমি নন, গোটা টিমই মাথা নীচু করেছে প্রশাসনের সামনে।”
নীতি পুলিশের মারে তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুতে ক্ষোভে ফুঁসছে ইরান। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে তিনি জানান, ”দেশের প্রায় সব শহরে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। সরাসরি প্রতিবাদীদের উপরে গুলি চালাচ্ছে পুলিশ ও সরকারি বাহিনী রিপাবলিকান গার্ড। মহিলা ও শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। ইজেহ শহরে অনেকেই বন্দুক হাতে পাল্টা লড়াই চালাচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন এসব তথ্য গোপন করছে। মানুষ এই সরকারকে চায় না।”
মিলাদ আরও বলেন, তাঁর শহরেও বিক্ষোভ চলছে। নীতি পুলিশের অত্যাচার অব্যাহত। কিন্তু সেই শহরের মানুষরা আত্মসমর্পণ করার বান্দা নন। তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবাদ। মিলাদ বলছেন, ”আমার মতোই আমার শহরের মানুষরা মানসিক দিক থেকে শক্তিশালী। কোনও রকম চাপের কাছেই আমরা মাথা নিচু করব না। এই বিক্ষোভ চলবে।”
মিলাদ যতই বলুন, দেশে ফিরলে চেসমি, আলিরেজাদের কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। অনেকেই আবার মনে করছেন বহু ইরানি নাগরিকের মতোই তাঁরাও আমেরিকা বা ইউরোপে শরণার্থীর মর্যাদা চাইতে পারেন।
ইরানের জাতীয় দলের কাজে ধন্য ধন্য করছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু দেশের মানুষ জাতীয় ফুটবল দলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছে, তাতে কিন্তু পরিষ্কার ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভীষণ জটিল। ভয়ের রাজনীতি চলছে সেখানে।