চারুবাক: কলকাতার মৈনাক বিশ্বাস, সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং আরো দু’তিনজন তরুণ এখনকার প্রজন্মের ছটফটানি, যন্ত্রণা, আবেগ, আবেগহীন প্রেম, ভালোবাসা, লিভ ইন সম্পর্ক নিয়ে বেশ কয়েকটি ছবি বানিয়েছে। সেগুলো অবশ্যই নজর কেড়েছিল। কিন্তু সদ্য মুক্তি পাওয়া অঞ্জন কাঞ্জিলালের ছবি “সহবাসে” (Sohobashe) একটু বেশিই চমকে দিল। চমকটা বিষয়ের দিক থেকে তো বটেই, ছবির নির্মাণও চোখ এবং মন দুইই কেড়ে নেয়। শুনেছি মূলত নাটকের মানুষ অঞ্জন। এই ছবিতেও সেই নাট্য অভিজ্ঞতা সুন্দর সিনেমার ঢং এই ব্যবহার করেছেন। চার পাঁচটি গান সত্যিই এছবির বড় সম্পদ। যেমন গানের ভাষা, তেমনি শিল্পীদের গায়ন! গানগুলোর সঠিক প্রয়োগ ছবির শরীরে এক কাব্যিক ছন্দ নিয়ে এসেছে। পরিচালক অঞ্জন কাঞ্জিলাল নিজেই লিখেছেন গানগুলি। বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে কিছু কবিতার লাইনও সুন্দর লেগেছে!
গ্রাম থেকে জীবনে সফল হবার স্বপ্ন চোখে নিয়ে শহরে আসা দুই তরুণ তরুণী তুসী আর নীল। অর্থের অভাবেই দুজনে মিলে একটি ফ্ল্যাটে লিভ ইন করে, বা বাধ্য হয়। অবশ্যই তাঁদের বাবা মা সেটা জানেন না। এবার যা হয় আরকি। ঘি আগুন পাশাপাশি থাকলে! সেটাই হল। সেই আগুনে হাওয়া দেওয়ার কাজ করল পিকুদা (রাহুল) নামের এক অভিভাবক মার্কা দাদা! এবং নীলের সহ্কর্মী পূজা(সায়ন্তনী), যে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য নীলকে ব্যবহার করতেও ছাড়েনি। তুসীর বাবা মা শেষপর্যন্ত দুজনের সম্পর্ক মেনে নেন।
[আরও পড়ুন: রাজকুমারের অভিনয়ই সেরা প্রাপ্তি, তবুও জমল না ‘হিট দ্য ফার্স্ট কেস’]
ছবির বক্তব্যে নতুনত্ব তেমন কিছু নেই, কিন্তু প্রেজেন্টেশনটাই বড়ই মজার। ফ্ল্যাট বাড়িতে তুসী ও নীলের সম্পর্কের ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা, বন্ধুদের নিয়ে খোলামেলা ধারণার জমাটি আড্ডা গুলো আজকের প্রজন্মের ভাল লাগবে। তবে ফ্ল্যাটটির সাজসজ্জা কিন্তু ওদের আর্থিক অনটনের কোনও প্রমাণ দেয়না! ভাল লাগে পারস্পরিক বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোর অবস্থান। পূজা যে ক্যারেয়েরিস্ট সেটা চিত্রনাট্যে একটু আড়াল করে রেখে নাটকীয় চমক দিয়েছেন। চলতি জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে পরিচালক পুরনো চিন্তার সমঝোতার কাজটিও করেছেন বেশ বুদ্ধির সঙ্গে। আগেই বলেছি, ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখা প্রতিটি গানই সৌমরিতের সুরে কানকে এবং মনকেও আরাম দেয়। আর রয়েছে মধুরা পালিতের ঝকঝকে,আবার কিছু দৃশ্যে আলো আঁধারের দুর্দান্ত ফটোগ্রাফি! এবার আসছি অভিনয়ে। তুসীর ভূমিকায় ইশা সাহা সাবলীল, স্বচ্ছন্দ এবং বাস্তব ও নাটুকে! নীলের চরিত্রে নতুন মুখ অনুভব কাঞ্জিলাল স্বাভাবিক হয়ে উঠতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি,অনেকটাই পেরেছেন। তবে এখনও অনুশীলন দরকার। পিকুদার চরিত্রে রাহুল এক কথায় দারুণ! পূজা হয়েছেন সায়ন্তনী, খুবই ভাল। স্বার্থের বাঁধনটি সুন্দর আড়াল করে রেখেছিলেন। তুলিকা বসু, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, পনেরো সেকেন্ডের একটি ক্যামিও চরিত্রে ব্রাত্য বসু তাঁর জাত চিনিয়ে দেন। এই ছবি আজকের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ফর্মুলা দিয়েই তৈরি! কিন্তু, তাঁরা তৈরি তো? দারিদ্র্য, বেকারত্ব,জীবনের চারদিকের সমস্যাদীর্ন বাস্তব জীবনের দুর্গতি এড়িয়ে, “সহবাসে” এক কৃত্রিম আলোয় ঝলমলে জীবনের শহুরে সমস্যাহীন মরীচিকা সাফল্যের পেছনে ছুটে চলা তরুণ প্রজন্মের আশা, স্বপ্নপূরণের ছবি দেখায়। জীবনের বাস্তব থেকে দূরে হলেও, পরিবেশনার মুন্সিয়ানায় চোখ জুড়িয়ে দেয়, এটা ছবির একমাত্র পজিটিভ পয়েন্ট।