স্টাফ রিপোর্টার: আর জি কর কাণ্ডে আবারও চাঞ্চল্যকর পর্দাফাঁস! মৃতা তরুণী চিকিৎসকের ন্যায়বিচারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে শামিল জুনিয়র ডাক্তারদের স্ববিরোধিতার আরও এক নুমনা ফাঁস হল এবার। আর জি করে ময়নাতদন্তে হাজির থেকেও তা নিয়ে ‘বেনিয়ম’-এর অভিযোগ তুলেছেন যে জুনিয়র ডাক্তাররা, কী আশ্চর্য, কলেজের ‘অ্যাডভাইসরি বোর্ড’ তথা হালের পরিচালন সমিতিতেও তাঁদেরই নাম রয়েছে! নির্যাতিতা তথা ‘অভয়া’র ন্যায়বিচার এই কমিটির রীতিমতো ঘোষিত একটি ‘অ্যাজেন্ডা’। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, ‘বেনিয়মে’র নিরিখে যে ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ার জেরে নির্যাতিতার ন্যায়বিচার প্রশ্নের মুখে, সেই ময়নাতদন্তেই হাজির জুনিয়র ডাক্তাররা কীভাবে ওই সমিতির সদস্য হন? বিশেষত, নির্যাতিতার ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে পদক্ষেপ করাই যখন সেই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য? কলেজের পঠনপাঠন ও সার্বিক বিষয়গুলি ওই বোর্ড বা কমিটিই আপাতত তদারকি করছে বলে জানা গিয়েছে। সেখানে তাঁদের ওই প্রতিনিধিদের নাম থাকা জুনিয়র ডাক্তারদের দ্বিচারিতারই নামান্তর বলে সরব হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল।
ময়নাতদন্ত চলাকালীন নিজেদের প্রতিনিধিরা হাজির থাকা সত্ত্বেও সেই ময়নাতদন্ত নিয়েই ‘বেনিয়ম’-এর অভিযোগ তোলা জুনিয়র ডাক্তারদের দ্বিচারিতা এর আগেই প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থল, সেমিনার হল লাগোয়া দেওয়াল ভাঙায় সম্মতি দিয়েও তা নিয়েই তথ্য ও প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সরব হওয়ায় জুনিয়র ডাক্তারদের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এই দুটি বিষয় নিয়ে শনিবার ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিরোধিতা করে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে কোনও ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত মেলেনি। এরই মাঝে কলেজের ওই সমিতি নিয়ে তাঁদের দ্বিচারিতার আরেক নমুনা ফাঁস হওয়ায় চাঞ্চল্য চরমে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, নথি ও সাক্ষী– সব ক্ষেত্রে এমন একের পর এক দ্বিচারিতা এবং নির্যাতিতার ময়নাতদন্তে ‘বেনিয়ম’ থেকে শুরু করে তথ্যপ্রমাণ লোপাট নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের তথাকথিত অসঙ্গতির তথ্য তবে কি সত্যিই কোনও অলীক কুনাট্যেরই অঙ্গ? ন্যায়বিচারের দাবির নাম করে আদতে স্বাস্থ্য তথা রাজ্য প্রশাসনকে কাঠগড়ায় তুলে অস্বস্তিতে ফেলার ছক?
++গত ৯ আগস্ট নির্যাতিতার দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানোর আগে আর জি করের তৎকালীন অধ্যক্ষের কাছে পাঁচটি শর্ত আরোপ করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এর নথি ইতিমধ্যেই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে স্পষ্ট যে, প্রথমে দু’জন পিজিটি বা ডাক্তারি পড়ুয়াকে ময়নাতদন্ত চলাকালীন মর্গে উপস্থিত থাকার শর্ত দেওয়া হয়। পরে ইংরেজিতে ‘টু’ শব্দটি কেটে ‘ফোর লেখা হয়। অর্থাৎ জুনিয়র ডাক্তারদের চাহিদা ছিল, চারজনকে ময়নাতদন্তের সময় উপস্থিত থাকতে দিতে হবে। কিন্তু নতুন যে নথিটি ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর হাতে এসেছে, তাতে স্পষ্ট যে, চারজনের বদলে শেষ পর্যন্ত পাঁচজন ডাক্তারি পড়ুয়া ময়নাতদন্তের সময় মর্গে হাজির ছিলেন। চারজনের নাম লেখার পর নিউরোমেডিসিনের এক চিকিৎসক তথা পড়ুয়ার নাম যোগ করা হয়। ওই নথিটিতে উল্লেখ রয়েছে যে, মর্গে উপস্থিত ওই পাঁচ জুনিয়র ডাক্তারই ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ায় হাজির থেকে এবং সব দেখেশুনে সন্তুষ্ট। নিচে যে পাঁচজন পিজিটির সই রয়েছে তাঁদের মধ্যে দু’জন প্রসূতি ও শিশু বিভাগ, দু’জন চেস্ট ও একজন নিউরো মেডিসিনের। সেই নথির নিচের অংশে সই করেছেন আর জি কর হাসপাতালের ফরেনসিক চিকিৎসক ডা. অপূর্ব বিশ্বাস, যাঁকে ইতিমধ্যেই একাধিকবার তলব করে জেরা করেছে সিবিআই।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এর পরও এই জুনিয়র ডাক্তাররাই কীভাবে ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন? ময়নাতদন্তে কোনও অসঙ্গতি লক্ষ্য করে থাকলে সেদিনই তো তাঁরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতেন। এই সূত্রেই স্রেফ ষড়যন্ত্রের ন্যারেটিভ সাজাতেই জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে ময়নাতদন্তে অসঙ্গতির অসাড় তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়। এই আবহেই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর হাতে এসে পৌঁছনো আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ওই ‘অ্যাডভাইসরি বোর্ড’ সংক্রান্ত নথি জুনিয়র ডাক্তারদের দ্বিচারিতা আরও বেআব্রু করে দিয়েছে। ওই বোর্ড তথা পরিচালন সমিতির সভাপতি পদে রয়েছেন ডা. অনিকেত মাহাতো ও সহ সভাপতি ডা. কিঞ্জল নন্দ, যাঁরা আর জি করের আন্দোলনের ‘মুখ’ বলে পরিচিত। এ ছাড়া পিজিটি রিয়া বেরা ওই সমিতির সহ-হিসাবরক্ষক, তিতাস পাল জুনিয়র রিপ্রেজেনটেটিভ ও রমা বেরা এগজিকিউটিভ মেম্বার, যাঁরা প্রত্যেকেই নির্যাতিতার দেহের ময়নাতদন্তের সময় উপস্থিত ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই সমিতির পক্ষ থেকেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘অভয়া’র বিচার চাওয়ার নামে ময়নাতদন্তে গরমিল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ‘অভয়া’র ন্যায়বিচারের দাবিও ওই সমিতির অন্যতম অ্যাজেন্ডা হিসেবেই ইতিমধ্যেই প্রচারিত। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, যাঁরা ময়নাতদন্তে ছিলেন এবং লিখিতভাবে সেই প্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, সেই জুনিয়র ডাক্তাররাই কীভাবে ময়নাতদন্তে বেনিয়ম ও ‘অভয়া’র ন্যায়বিচারের দাবিতে সরব ওই সমিতির সদস্য হন? তাঁদের এই স্ববিরোধী অবস্থান সমিতির অন্য সদস্যরাই বা কী করে মেনে নেন? ওই সমিতিতে আর জি করের এখনকার অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে এমএসভিপিও রয়েছেন। জুনিয়র ডাক্তাররা কি আন্দোলনের অছিলায় নিজেদের এই মারাত্মক দ্বিচারিতা সম্পর্কে তাঁদের ইচ্ছাকৃতভাবেই অন্ধকারে রেখেছেন?
গত ৯ আগস্ট ওই তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের দিনেই আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের বিশ্রামের জায়গা, শৌচাগার তৈরির দাবি তুলে সরব হন জুনিয়র ডাক্তাররা। সেই কাজের জন্য গত ১০ ও ১২ আগস্ট দু’দফায় পরিদর্শনের পর যে বৈঠকে বিভিন্ন ঘর ভাঙা ও মেরামতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তার কার্যবিবরণীতেও জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাক্ষর মিলেছিল। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ সেই সূত্রেও জুনিয়র ডাক্তারদের দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় প্রতিবেদনে। কিন্তু তারও কোনও প্রতিবাদ বা ব্যাখ্যা এপর্যন্ত জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে দেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে কলেজের ‘অ্যাডভাইসরি বোর্ড’ সংক্রান্ত ওই নথি ফাঁসের সুবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের স্ববিরোধিতা ও দ্বিচারী অবস্থান আরও একবার প্রকাশ্যে এল। প্রশ্ন থাকছেই, এর ব্যাখ্যাও কী আদৌ মিলবে? নাকি নারকীয় এই ঘটনা ও পরে উঠে আসা নানা অভিযোগের সঙ্গে নিজেদের ছোঁয়াচ এড়াতে আন্দোলনের আড়ালই খুঁজবেন ‘বিপ্লবী’ জুনিয়র ডাক্তাররা?