অরিঞ্জয় বোস: ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনও দাবি দাওয়া/ এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া।’ নাগরিক কবিয়াল মাফ করবেন, বিনা অনুমতিতে আপনার কণ্ঠনিঃসৃত মধুর বাণীর আশ্রয় নিলাম। নেওয়া ছাড়া কী বা উপায় ছিল! এ ভরা বসন্তে, রৌদ্রকরোজ্জ্বল একটা দিন। এমন দিনে মনের দখিন-দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য তাঁর আগমনটাই যে যথেষ্ট। আর সেই আগত তিলোত্তমা যদি হন সানিয়া মির্জা, তা হলে এই নিষ্পাপচিত্ত, এই অপাপবিদ্ধ চর্মচক্ষুর কী দোষ! স্থাণুবৎ হয়ে যাওয়াই তো কথা এ হৃদয়স্পন্দনের। বসন্তের দামাল বাতাসে তখন নাগরিক কবিয়াল, এই আপনার গানই দিশাহারা আশ্রিতের ভরসা।
শহরের বুকে আরও একটা আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সেই আবহে নীল আকাশের তলে কলকাতার মাটিতে ভারতীয় টেনিস সম্রাজ্ঞীর আগমন তাৎপর্যপূর্ণ। যেন নারীত্বের চেতনাকে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে ক্যানভাসে ডানা মেলেছে কোনও রাতজাগানিয়া ‘স্কাইলার্ক’। ‘স্পোর্টস কনক্লেভে’ অংশ নিতে ‘আইটিসি রয়্যাল বেঙ্গল’-এ যখন পা রাখলেন সানিয়া, মনে হল প্রাণ পেল পাঁচতারার রাজপ্রাসাদ। সুদৃশ্য গথিক থামের আড়ালে মুখ লুকনো বসন্তের তাজা ফুলও যেন উজ্জীবিত তাঁর আগমনী ছোঁয়ায়। আর সানিয়াকে কাছে পেয়ে উদ্বেলিত খেলাপ্রেমী কলকাতার জনতা। একটা ছবি তোলার আকুতি থেকে অটোগ্রাফের আকুল প্রার্থনা, মুগ্ধতার পরশ মেখে ঝরে পড়ল তাঁর সামনে। শান্তচিত্তে অনুরাগীর আশ মেটালেন তিনি।
[আরও পড়ুন: ধরমশালায় ইতিহাস অ্যান্ডারসনের, প্রথম পেসার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৭০০ উইকেটের মালিক]
কে বলবে, সানিয়া অবসরোত্তর জীবন কাটাচ্ছেন! কে বলবে, শোয়েব-বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তিনি আজ একা। বরং, তাঁর দীপ্তময় উপস্থিতি প্রমাণ করে দেয়, সানিয়া আসলে স্বয়ংসিদ্ধা। তাঁর তুলনা শুধু তিনি। সানিয়া নিজেও যেন তা বিশ্বাস করেন না মনেপ্রাণে। কনক্লেভে ব্যস্ততার ফাঁকে বলেও গেলেন সেকথা। কেন আজও তৈরি হল না এই দেশের মাটিতে সানিয়ার বিকল্প? টেনিস সম্রাজ্ঞীর উত্তর, “গত পনেরো বছরে বিশ্বের যে প্রান্তেই যাই না কেন, এ প্রশ্ন আমায় শুনতে হয়– আপনার পরে কে? সত্যি বলতে, জবাব আমার কাছেও নেই। দেশের অন্যান্য স্পোর্টসে যেভাবে নতুন মুখ উঠে এসেছে, তেমনটা টেনিসে হয়নি। এটা দু্র্ভাগ্যজনক। খারাপ লাগে দেখে। গত পাঁচ বছরে সেভাবে কাউকে দেখে মনে হয়নি যে আমার পর ভারতীয় মহিলা টেনিসের ব্যাটনটা বয়ে নিয়ে যাবে। কারও মধ্যে ইচ্ছাশক্তি চোখে পড়েনি।” তবু উপেক্ষা নয়, আশার আলো জ্বেলে সানিয়া বলেন, “তিরিশ বছর আগে যে পরিকাঠামোগত সুযোগ পাইনি, আমি চাই এই প্রজন্ম যেন তা থেকে বঞ্চিত না হয়।”
কথায় বলে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। সানিয়া তো পেরেছেন। নারীত্বের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন– মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার পরেও ফিরেছেন। ২৬ কেজি ওজন হ্রাস করার পরে ফের টেনিসে চেনা বিচ্ছুরণ আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম সানিয়ার (Sania Mirfza) খেলায়। কোন মন্ত্রবলে করেছিলেন অসাধ্যসাধন? সানিয়ার কথায়, “সময় আমায় পরিণত করেছে। এটা একটা লড়াই। সময়ের সঙ্গে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তাই আমাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। বছরের পর বছর। তিরিশ বছর আগেও কখনও ভাবিনি, সেই জায়গায় পৌঁছতে সক্ষম হব। শুরুর দিনে কিছু স্বপ্ন সঙ্গী ছিল– উইম্বলডন খেলব। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হব। ডাবলসে এক নম্বর হব, তা ভাবিনি। জেতার খিদে ছিল বলেই এ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছি।” সানিয়া পেরেছিলেন। পেরেছিলেন বলেই আজও তাঁকে ঘিরে এমন অবিশ্বাস্য উন্মাদনা বিরাজ করে। কনক্লেভে মঞ্চে সেই অতিমানবীকে দেখলে ভ্রম জাগে, যেন মাটির মানুষ। অক্লেশে ডেকে নেন জ্যোৎস্না চিনাপ্পাকে। চায়ের পেয়ালা হাতে মেতে ওঠেন ‘খোশগপ্পে’। গল্প জুড়ে দেন নিখাত জারিনের সঙ্গে। দেখে মনে হয়, চিরচেনা এই রক্তমাংসের ‘মানসী’। আমাদের ঘরের মেয়ে।
তবু সানিয়াকে চেনাবৃত্তে ফিরতে হয়। ফিরতে হয় চিন্তকরূপে, ভারতীয় টেনিসের ভবিষ্যৎ ভাবনায়। যেখানে ভিড় করে আসেন রোহন বোপান্নার (Rohon Bopanna) মতো সফল মুখ। উঠে আসে সানিয়ার কামব্যাকের কাহিনি। রোহনের কথা উঠতেই স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, “অনেক দেরিতে ওর সাফল্যকে কুর্নিশ জানানো হল। লিয়েন্ডার, মহেশ যে মর্যাদা পেয়েছে, সেটা রোহনেরও প্রাপ্য। বরাবর ওদের ছায়ায় রোহন ঢাকা পড়েছে। উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে।” আবার এই সানিয়াকেই নিজের কামব্যাকের প্রশ্নে পাওয়া যায় ভিন্ন আঙ্গিকে। ‘মাতৃকা শক্তি’র প্রতিভূ হয়ে ওঠা টেনিস-কুইন তখন অনর্গল, “মা হওয়ার পর টেনিসে ফেরা সহজ ছিল না। তবে সচেতনভাবে চেয়েছিলাম, নিজের কামব্যাকের মধ্যে দিয়ে সিঙ্গল মাদারদের উদ্বুদ্ধ করতে। আসলে মাতৃত্ব তো নারীজীবনের এক বিশেষ অনুভূতি। সেটা তো প্রতিবন্ধকতা নয়। তাই টেনিসে ফেরাটা আমার জন্য জরুরি ছিল।” সানিয়া পেরেছেন। প্রত্যাবর্তনকে অবিশ্বাস্য পর্যায়ে উত্তীর্ণ করে রাঙিয়ে দিয়েছেন সাফল্যের রঙে। টানা ৪৩-৪৪ সপ্তাহ অপরাজেয় হয়ে বিরাজ করেছেন টেনিসবিশ্বে। এর নেপথ্যে যে আত্মত্যাগ, তাতে যে পরিবারের ভূমিকাও রয়েছে, অকপটে জানাতে ভোলেননি নিজাম-সুন্দরী। তাঁর কথা শুনলে মনে পড়ে যাবে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই অমোঘবাণী, ‘কারেজ ইজ গ্রেস আন্ডার প্রেসার।’
[আরও পড়ুন: মেরি কমের রেকর্ড ভাঙার চেষ্টাই আমি করব না, অলিম্পিকের আগে জানিয়ে দিলেন নিখাত]
তবে কি সানিয়ার স্বপ্নের দুনিয়া সোনায় মোড়া, সেখানে কোনও আক্ষেপের খাদ নেই? না, জীবনে অলিম্পিক (Olympic) পদক জিততে না পারাটা আজও যন্ত্রণা দেয় ৩৭-এর হায়দরাবাদিকে। আর আছে স্বপ্ন, ছেলে ইজহানকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। মনেপ্রাণে চান, প্রত্যাশার চাপ যেন ইজহানের গায়ে চেপে না বসে। বলেন, “ও যা হতে চায়, সেটাই হোক। ওর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা। চাইব, ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক।” এসব শুনতে শুনতে মনে হয়, সানিয়া মির্জা কোনও মানবী নন, মায়াবী কিছু। কিংবা স্বয়ংসম্পূর্ণা। জাগ্রত বসন্তের মতো। চিরকালের, চিরদিনের।