রমেন দাস: যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার সেই রূপকথা! সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়ে তোলা, সম্মোহিত করে রাখা! দমদম স্টেশনেই (Dum Dum Station) দেখা মেলে এই বাঁশিওয়ালার (Flute Player)। কেবল স্টেশন নয়, রবীন্দ্রসদন চত্বরের ভিড়েও আচমকাই সুরের ফুল ফুটিয়ে তোলেন অনিলকুমার মহন্ত (Anil Kumar Mohanta)। গোটা কলকাতার ‘কালের রাখাল’ হয়ে।
ব্যস্ততম দমদম স্টেশনের সাবওয়ে ঠিক যেখানে শুরু হয় সেখানেই অর্থাৎ কলকাতা মেট্রো পরিসরের সূচনায় দেখা মেলে এই ‘বাঁশি বুড়ো’র। এক চিলতে জায়গায় নিত্যযাত্রীদের আনাগোনার মধ্যেই বসে থাকেন পূর্ব বর্ধমানের (Purba Bardhaman) মন্তেশ্বরের (Manteswar) মানুষটি। পথচলতি মানুষ গন্তব্যের দ্রুততায় যেতে যেতে শরীরে মেখে নেন তাঁর বাঁশির মোহিনী সুর।
[আরও পড়ুন: কমছে স্বাদ, বাড়ছে বিপদ! ভোজনরসিকদের ‘তাণ্ডবে’ সংকটে ইলিশের ভবিষ্যৎ]
আগে নিয়মিত কলকাতা আসতেন তিনি। এখন বয়স থাবা বসিয়েছে প্রবীণ শরীরে। কিন্তু এই বয়সেও দমে যাননি বছর ৬৭-র ‘তরুণ’ অনিল। দুই সন্তানের বাবা আজও বাঁশির টানে পাড়ি দেন তিলোত্তমায় (Kolkata) । ভিড় ট্রেনে কলকাতা আসেন। দমদম স্টেশনের পরিচিত সাবওয়েতে বসেই হিল্লোল তোলেন বাঁশির সুরে। তাঁর শিল্পের প্রদর্শনে বিমুদ্ধ হন বহু। শিল্পীর প্রকাশে দাঁডিয়ে পড়েন কেউ কেউ। কিন্তু ”একটু চা খাওয়াবেন!” কাউকে বাঁশি শুনতে দেখলেই এই প্রশ্নই করে বসেন বাঁশিওয়ালা! কেন?
অনিলের কথায়, ”বাঁশি বাজিয়ে কিন্তু পেট চলে না! সারাদিন বসে থাকি! আগে অনেকেই কিনতেন, এখন আর বাঁশি কেনেন না কেউ!” বলতে বলতে চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে জল। তাঁর কথায়, ”বয়স হয়েছে আর পারি না রোজ কলকাতা আসতে। এখন মাঝে মাঝে আসি। এখানে থাকি বসে। আর রাতে…!” শিল্পী জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন প্রবীণ অনিল। বাঁশির সঙ্গেই কাটিয়েছেন বহু বসন্ত। তবে কলকাতায় কোনও ঘর নেই তাঁর! দিনে স্টেশন, আর রাত হলেই ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুনশান কলেজ স্ট্রিটে শুয়ে থাকেন তিনি। বইয়ের পাঁজার ভিড়ে এলিয়ে দেন ক্লান্ত শরীর।
বিক্রি নেই, রোজগার নেই। তবু কেন এত কষ্ট করেন বাঁশিওয়ালা? শিল্পীর (Pieper) জবাব, ”আমি সুর ভালবাসি। বাঁশিতেই খুঁজে পাই বেঁচে থাকার রসদ। তাই একাজ আজও করে চলি। পেটে খাবার না থাকলেও আমৃত্যু বাঁশি নিয়েই বাঁচতে চাই!”
মাঝে মাঝে ফেরেন বাড়িতে। বর্ধমানের সেই বাড়িতে বসেই কয়েকটা বাঁশি তৈরি করেন এই শিল্পী। তারপর কাঁধের ঝোলায় বন্দি হয়ে সেই বাঁশি কখনও পাড়ি দেয় রবীন্দ্রসদন চত্বর, কখনও তা সাময়িকভাবে বাসা বাঁধে দমদম স্টেশনে। অনিলের কথায়, ”যখন মেট্রো (Kolkata Metro) শুরু হয়নি তখন সব সময় রবীন্দ্রসদনে (Rabindra Sadan) থাকতাম। এখন দমদম ছেড়ে শুধু শনিবার বিকেলে যাই নন্দন চত্বরে (Nandan Kolkata)। সেখানেও তেমন একটা বিক্রি হয় না বাঁশি।”
এত লড়াইয়ের পরেও পেশা বদল করেননি কেন? শিল্পীর জবাব, ”মাকে ভালবাসার সময় কি কেউ স্বার্থ দেখে? আমিও তাই। এই জিনিস জীবনেও ছাড়তে পারব না!” কিন্তু এত কম উপার্জনে কী করে চলে সংসার? আসলে বর্ধমান, নদিয়া, কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর বহু ছাত্র। যাঁরা বাঁশি শেখেন ‘অনিল স্যরে’র কাছে। তা থেকেই হয় সামান্য রোজগার! শিল্পী আক্ষেপের সুরে বলছেন, ”কেউ কেউ ভালবেসে খেতে দেন। কেউ টাকা দিয়ে যান। এভাবে হাত পেতেই চলে আমার বাঁশির জীবন!” আসলে জাগতিক জীবনের সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয় সুরের স্পর্শ। সেখানেই যে মেলে অপার্থিব আনন্দের দ্যোতনা। তার কাছে বাকি সব তুচ্ছ! সুরকে ছেড়ে বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারেন না অনিল। তাই কোটি কোটি জনতার ভিড়ের শব্দেও বাঁশির সুরে যেন এক আকাশ সুখ কিনতে চান এই বাঁশিওয়ালা! কী সম্ভব, কী সম্ভব নয়, তা তিনি জানেন না। শুধু জানেন এভাবেও বেশ ভাল থাকা যায়!