বিশ্বদীপ দে: ‘… প্রথমে একটা মসৃণ বলের মতো মাথা, তারপর একটা অদ্ভুত প্রাণীর সমস্ত শরীরটা। লিকলিকে শরীরের মাথা বাদে সমস্তটাই একটা চকচকে গোলাপি পোশাকে ঢাকা।’ বাঙালি পাঠকের কাছে এই বর্ণনা কতটা চেনা তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। গল্পের নাম ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’। বাবা ও ঠাকুরদার স্বপ্নের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নতুন করে শুরু করার পরে পত্রিকার পাতা ভরাতেই লেখক সত্যজিতের (Satyajit Ray) কলম হাতে তুলে নেওয়া। আর তারপরই লেখা হয়েছিল এই গল্প। ভিনগ্রহের আগন্তুক পৃথিবীতে এসে পড়া মানেই যুদ্ধবিগ্রহ করতে আসা, তা যে নাও হতে পারে সেই বার্তাই ছিল এই গল্পের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সুদূর ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং হয়ে উঠেছিল বঙ্কুবাবুর বন্ধু। এই গল্পই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিল ‘দ্য এলিয়েন’ ছবির মূল অনুপ্রেরণা। যদিও সিনেমার গল্প একেবারেই আলাদা। তা সত্ত্বেও নিজের লেখা ছোটগল্প মাথায় রেখেই যে সত্যজিৎ ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন, তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
‘দ্য এলিয়েন’। যে ছবির কথা জানতে পেরে কেঁপে উঠেছিল হলিউড-সহ গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্র জগৎ। শুরু হয়েছিল তুমুল উন্মাদনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ছবি হয়নি। অথচ ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ইটি: দ্য এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল’ ছবির সঙ্গে আশ্চর্য মিল সত্যজিতের না হওয়া ছবির! সত্যজিৎ রায়ের একশো বছরে নানা স্মৃতির সঙ্গে ফিরে ফিরে আসছে এই ঘটনাও। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন খোদ সত্যজিৎই।
ঠিক কী হয়েছিল? সেকথা বলতে গেলে একটু শুরু থেকেই শুরু করা যাক। ১৯৬৬ সাল। সত্যজিৎ সেই সময় লন্ডনে। সেখানেই দেখা আর্থার সি ক্লার্কের সঙ্গে। ‘২০০১: এ স্পেস ওডিসি’ ছবির সূত্রেই কিংবদন্তি কল্পবিজ্ঞান লেখকও তখন সেখানে। দুই বিখ্যাত মানুষের সেই প্রথম আলাপ। জমে উঠল আড্ডা। আর সেই আড্ডার সূত্রেই সত্যজিৎ ক্লার্ককে বলেন তাঁর মাথায় একটি ছবির আইডিয়া রয়েছে। কল্পবিজ্ঞান ছবি। গল্পের আইডিয়া শুনে তো উচ্ছ্বসিত ক্লার্ক! তিনি খুবই উৎসাহ দিলেন।
শুধু উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। তাঁরই নির্দেশে কিছুদিনের মধ্যে ভারতে এসে সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করলেন মাইক উইলসন। তিনি ক্লার্কের এজেন্ট। এই ভদ্রলোকের তাগাদাতেই অন্যান্য হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও সত্যজিৎ দ্রুত শেষ করে ফেলেন ছবির চিত্রনাট্য। পরের ঘটনাও ঘটতে থাকে দ্রুত। ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হন বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা পিটার সেলার্স। বিখ্য়াত কলম্বিয়া পিকচার্সও রাজি হয়ে যায় ছবিটি করতে। আসলে ততদিনে সত্যজিৎ গোটা বিশ্বের কাছে এক অবিস্মরণীয় নাম হয়ে গিয়েছেন। তাঁর ছবিতে কাজ করতে তখন উন্মুখ বিশ্বের তাবড় তাবড় চলচিত্র ব্যক্তিত্বরা। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান হাস্কেল ওয়েক্সলার জানিয়েছিলেন, তিনি সত্যজিতের ছবিতে কাজ করবেন। কেবল একটাই শর্ত। কোনও পারিশ্রমিক তিনি গ্রহণ করবেন না। ছবি করতে প্রবল উৎসাহী ছিলেন মার্লন ব্র্যান্ডোর মতো ডাকসাইটে হলিউড তারকাও। ব্র্যান্ডোর তো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয়ের কথা মোটামুটি পাকাও হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যেই ১৯৬৭ সালে কলম্বিয়ার সঙ্গে সত্যজিতের চুক্তি হয় ১০ হাজার ডলারের। সেই সময় এই অঙ্ক অভাবনীয়। তবু… তৈরিই হল না সেই ছবি। এ এক বিরাট ট্র্যাজেডি। যে ছবি হতে পারত সত্যজিতের শিল্পকর্মের এক বিশেষ অলঙ্কার, তা পৃথিবীর আলোই দেখল না!
[আরও পড়ুন: প্রকাশ্যে অনীক দত্তর ‘অপরাজিত’ ছবির ট্রেলার, ফিরল ‘পথের পাঁচালী’র স্মৃতি]
এর পিছনে অন্যতম দায়ী ব্যক্তিটির নাম মাইক উইলসন। ‘দ্য এলিয়েনে’র চিত্রনাট্য জমা দেওয়ার সময় তিনি লিখে দিয়েছিলেন কপিরাইট সত্যজিতের সঙ্গে তাঁরও! এখানেই ছিল সমস্যা। চুক্তির ওই প্যাঁচ পয়জার ধরতে পারেননি সত্যজিৎ। ক্রমেই বিষয়টা জটিল হতে থাকে। এদিকে পিটার সেলার্স হঠাৎই বেঁকে বসে জানালেন এই চরিত্রে তাঁকে মানাচ্ছে না। বিকল্প অভিনেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিলেন মাইক। কলম্বিয়া পিকচার্সের তরফেই তখন সত্যজিৎকে বলা হয় মাইককে পুরো বিষয়টি থেকেই সরিয়ে দিতে। আসলে উইলসন নিজের নামটি রেখেছিলেন প্রযোজক হিসেবে। কিন্তু কলম্বিয়া পিকচার্স জানায় উইলসন নয়, তারাই ছবিটি প্রযোজনা করবে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও মাইককে সরানো যায়নি। একসময় হাল ছেড়ে দেন সত্যজিৎ। ১০ হাজার ডলারের কানাকড়িও তাঁর হাতে আসেনি। মাইক উইলসনের বদান্যতায় কোন এক অনতিক্রম্য ব্ল্যাক হোলে যেন তলিয়ে গেল সব কিছু।
এর অনেক পরে স্পিলবার্গের ‘ক্লোজ এনকাউন্টার্স অফ দ্য থার্ড কাইন্ড’ (১৯৭৭) ও ‘ইটি: দ্য এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল’ (১৯৮২) ছবি দেখে সত্যজিৎ চমকে ওঠেন। ধরতে পারেন তাঁর আইডিয়া ও চিত্রনাট্যের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে গল্পগুলির! ১৯৮৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ পরিষ্কার বলেন, ”আমার লেখা ‘দ্য এলিয়েনে’র চিত্রনাট্যটি ছাড়া এই ছবিই তৈরি করতে পারতেন না স্পিলবার্গ।” একই মত ছিল আর্থার সি ক্লার্কেরও। লেখালেখি হয় ‘লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে’ও।
সত্যজিতের ধারণা ছিল তাঁর ছবির চিত্রনাট্যের অসংখ্য কপিই নাকি ছড়িয়ে গিয়েছিল হলিউডে। ফলে তা ‘লিক’ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্পিলবার্গ। তিনি জানিয়েছেন, যে সময় সত্যজিৎ হলিউডে, সেই সময় তিনি নাকি নেহাতই স্কুলপড়ুয়া। যদিও তাঁর এই দাবি সত্যি নয়। ততদিনে হলিউডে ইন্টার্নশিপ শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি।
সত্যজিৎ অবশ্য পরেও ছবিটি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বারবার আলাপ-আলোচনার পরও শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসেনি। এক রেডিও সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎকে বলতে শোনা গিয়েছিল, এরপর তিনি ওই ছবি করলেই বলা হবে, স্পিলবার্গের থেকেই আইডিয়া ‘ধার’ করেছেন তিনি। অথচ আসলে তো বিষয়টা একেবারেই উলটো!
বাঙালি, স্রেফ বাঙালি কেন সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রমোদীর কাছেই এটা চরম আফশোসের যে ‘দ্য এলিয়েন’ তথা ‘অবতার’ (ভারতীয় সংস্করণের এই নামই রাখা হয়েছিল) ছবিটি হয়নি। হলে যে তা কল্পবিজ্ঞান ছবির ক্ষেত্রে এক মাইফলক হয়ে থাকত, তা বলাই বাহুল্য। কথা হচ্ছিল সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ ঋদ্ধি গোস্বামীর সঙ্গে। ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল’কে তিনি বলছিলেন একটি বইয়ের কথা। ‘হার্পার কলিন্স’ থেকে প্রকাশিত ‘ট্র্যাভেলস উইথ দ্য এলিয়েন’ নামের সেই বইয়ে ‘দ্য এলিয়েন’ ছবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। রয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি, সাক্ষাৎকার যা প্রমাণ করে দেয় স্পিলবার্গের কত আগে ‘বন্ধু’ এলিয়েন কেমন এক অন্য রকম ছবি উপহার পেতে পারত বিশ্ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল। যেকথা বলতে বলতে বইটির অন্যতম পরিকল্পনাকারী ঋদ্ধির গলায় ধরা পড়ল হতাশার সুর। তাঁর কথায়, ”পরেও চেষ্টা হয়েছিল ছবিটি করার। কিন্তু হয়নি। সত্যজিৎ নিজেও জানিয়েছেন, তাঁর মন কতটা তিক্ত হয়ে গিয়েছিল এই অভিজ্ঞতায়। হলে যে কী হত…!”
হলে কী হত, ভাবলে আজও সত্য়িই রোমাঞ্চিত হয় সিনেপ্রেমীদের মন। কিন্তু ইতিহাসের সব অধ্যায় যে সব সময় সম্পূর্ণতা পায় না। ‘দ্য এলিয়েন’ ছবিটি তৈরি হয়নি। কিন্তু রয়ে গিয়েছে চিত্রনাট্য। যা প্রতি মুহূর্তে সাক্ষ্য দেয়, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা সত্যজিতের এই সৃষ্টির পরিপূর্ণতা না পাওয়া মোটেই সত্যজিতের কোনও ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়। এই ক্ষতি কল্পবিজ্ঞান ছবি তথা সমগ্র রুপোলি পর্দার দুনিয়ারই।