দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতেও বিজেপি এবার ভালো ফল করবে। বাংলার উন্নয়নে হাজার-হাজার কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্র। ‘ইন্ডিয়া’ জোট ঘাঁটা প্রকল্প। দিল্লিতে নিজের সরকারি বাংলোয় বসে জাতীয় থেকে বঙ্গ-রাজনীতি নিয়ে নানা কথা বললেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুর (Anurag Thakur)। কথায় সংবাদ প্রতিদিন-এর দিল্লি ব্যুরো চিফ নন্দিতা রায়।
প্রথম দফার ভোট শেষ। এই দফায় সবথেকে বেশি ১০২টি আসনে ভোট হয়েছে। গতবারের তুলনায় এবার এই আসনগুলি থেকে কী আশা করছেন?
প্রথম দফার আসনগুলিতে গতবারের চেয়েও ভালো ফল হবে আমাদের। যেমন, তামিলনাড়ু। সেখানে বিজেপির জন্য খুবই ভালো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আগে কোনও দিন সেখানে আমাদের জন্য লক্ষ লোকের ভিড় হয়নি। এবারে তা হয়েছে। তামিলনাড়ুর মানুষরা মনে করেন, তাঁদের সেঙ্গলকে যদি কেউ সংসদে জায়গা দিয়ে থাকেন, তিনি নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)। তামিল ভাষাকেও প্রধানমন্ত্রী অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সেখানকার রাজ্য নেতৃত্বও যেভাবে কাজ করেছে– তাতে মানুষের মনে ‘বিকল্প’ হিসাবে বিজেপির (BJP) নাম উঠে এসেছে।
লোকসভা নির্বাচনে চারশো আসন পার করবে এনডিএ। বিজেপি পাবে ৩৭০ আসন– এমনটাই ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই লক্ষ্যপূরণ কি আদৌ সম্ভব?
৩৭০ কোথা থেকে আসবে! গতবার যেভাবে ৩০৩ এসেছিল, সেভাবে। এবারের ওড়িশার নির্বাচন দেখুন, সেখানে রাজ্য সরকারও বিজেপি তৈরি করবে, লোকসভা আসনও বাড়বে। অন্ধ্রপ্রদেশে আমাদের জোট ভাল ফল করবে। তেলেঙ্গানায় আমাদের আসন গতবারের ৪ থেকে বেড়ে কমপক্ষে ৯টা হবে, এমনকী ১০টাও হতে পারে। তামিলনাড়ু-সহ দক্ষিণ ভারতে ভালো ফল হবে। কেরলেও আমাদের ভোট শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ঝাড়খণ্ডে বিজেপি ভাল করবে। অসম থেকে শুরু করে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত, সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও ভালো ফল হবে। মণিপুরের দুটো আসনও আমরা পাব। দেশের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে তৈরি হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে ভালো ফল করব। এবারে নির্বাচনে একটা বিশেষ ব্যাপার রয়েছে– মানুষ মোদিজি-র নামে ভোট দিচ্ছেন। দেশের সুরক্ষা, সম্মান, সমৃদ্ধি এবং দেশকে শক্ত করার জন্যই এবারের ভোট হচ্ছে। বিরোধীদের উপর মানুষ বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসযোগ্যতা বড় একটা বিষয়। আর, দেশে বিশ্বাসযোগ্যতা সবথেকে বেশি নরেন্দ্র মোদিরই রয়েছে।
[আরও পড়ুন: প্রকাশ্যেই স্মরণ করান ‘রাজধর্ম’, মরিয়া চেষ্টাতেও মোদিকে সরাতে পারেননি বাজপেয়ী! কেন?]
‘সিএএ’ পশ্চিমবঙ্গের ভোটের বড় ইস্যু। সেখানকার মানুষের মনে ‘সিএএ’ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলছেন। অথচ, যঁারা আবেদন করার পর নাগরিকত্ব পাবেন না, তঁাদের কী হবে, সেটা স্পষ্ট নয়। বাংলার ভোটে এর প্রভাব বিজেপির জন্য নেতিবাচক হতে পারে বলেও অনেকেই মনে করছেন।
নিয়মানুসারেই সব হবে। ২০১৪ সালের আগে যঁারা এসেছেন, ‘সিএএ’ অনুযায়ী তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন। বাকিদের এখনও পর্যন্ত কী হয়েছে? এখনও পর্যন্ত তাঁরা তো এ-দেশেই রয়েছেন।
[আরও পড়ুন: দূরদর্শনের গেরুয়াকরণে ‘স্তম্ভিত’ মমতা, কমিশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি]
বাংলার ভোটের আরও একটি বড় ইস্যু কেন্দ্রীয় বঞ্চনা। বাংলার প্রাপ্য টাকা দীর্ঘ দিন আটকে রেখে কেন্দ্র অর্থনৈতিকভাবে বাংলাকে অবরুদ্ধ করতে চাইছে, যাতে রাজ্য সরকার উন্নয়নমূলক কাজ করতে না পারে। এই মর্মে সেখানকার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী প্রচার করছে। একশো দিনের কাজের টাকা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা কেন্দ্রীয় সরকার আটকে রেখেছে বলেও অভিযোগ। এই বিষয়টিকে আপনারা কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
মা-মাটি-মানুষের বিরোধী এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। মহিলারা সুরক্ষিত নন। সন্দেশখালির ঘটনা দেশের গলিতে-গলিতে এই ‘সন্দেশ’ পৌঁছে দিয়েছে– মহিলাদের কীভাবে অপমানিত ও প্রতারিত করা হয়েছে সেখানে। বাংলার মাটিতে দুর্নীতি থেকে শুরু করে দুর্নীতিগ্রস্ত এমনকী আতঙ্কবাদী ভাবনার লোকেদের কীভাবে সংরক্ষণ দেওয়া হচ্ছে– তা-ও মানুষ দেখতে পাচ্ছে। সেখানে ‘এনআইএ’-র উপর, ‘ইডি’-র উপর পাথর ছোড়া হয়। ‘একশো দিনের কাজ’ হোক বা ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’, ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি’ হোক বা ‘আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প’– সবকিছুর বিরোধিতা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন তিনি কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে বাংলায় লাগু করতে দেন ন? একশো দিনের কাজ, মনরেগা-য় নিয়ম রয়েছে জিও ট্যাগিং করতে হবে, টাকা অ্যাকাউন্টে যাবে– সারা দেশ সেটা মানছে– মমতাজি সেটা মানছেন না। একটা রাজ্যের জন্য কি আলাদা আইন হবে? যেমন, কংগ্রেস বলছে আমাদের জন্য আলাদা আইন করে দাও, আমরা আয়কর রির্টান জমা দেব না। বাকি সমস্ত রাজনৈতিক দলই আয়কর রির্টান জমা দেয়। মানুষ কিন্তু জানে, সত্যিটা কী, আর কারা সত্যি বলছে। বাংলার উন্নয়নের জন্য আমরা হাজার-হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। মমতাজি নিজে রেলমন্ত্রী থাকার সময় যা করেননি, আমরা সব করেছি। শিলিগুড়ি থেকে তিনটে ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন চলছে। আমি বাংলার সরকারকে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, হিসাব সামনে নিয়ে আসুন। ইউপিএ জমানায় ২০০৪-’১৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রর কাছ থেকে কী কী পেয়েছেন, আর এনডিএ ও বিজেপির জামনায় ২০১৪-’২৪ সাল পর্যন্ত টাকা থেকে শুরু করে কী কী প্রকল্প পেয়েছেন– সব তথ্য প্রকাশ হলেই আসল ছবি উঠে আসবে। ওঁরা না দিতে পারলে হিসাব আমি দিয়ে দেব।
বিরোধীদের অভিযোগ, আপনারা দেশের ‘আসল’ সমস্যা, যেমন কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয় নিয়ে কোনও কথা-ই বলছেন না!
আসলে এঁদের কাছে আগামী দিনের স্পষ্ট কোনও ছবিই নেই। আমাদের তো কাজ-ই বিকাশ। বিজ্ঞান থেকে স্টার্ট আপ, স্পোর্টস থেকে স্পেস– ভারতের উন্নতি হচ্ছে। এবং তা উপরের দিকে যাচ্ছে। স্পোর্টসে শতাধিক মেডেল আসছে। আর রাহুল গান্ধী কী করছেন? না, অলিম্পিকের বিরোধিতা করছেন। বিগত দু’-বছরে মহাকাশের ক্ষেত্রে দুশো-র বেশি স্টার্ট আপ হয়েছে। ভ্যাকসিন তৈরির যে-কাজ আমরা করেছি তা সারা বিশ্বের নজর টেনেছে। আগে আমরা আমদানি করতাম, এখন রফতানি করছি। সংবিধান তো সবচেয়ে বেশিবার সংশোধন করেছে কংগ্রেস-ই। নেহরুজি থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী। কংগ্রেস যে সংবিধান মানে না, তার সবথেকে বড় উদাহরণ ‘জরুরি অবস্থা’।
বিরোধীদের আরও অভিযোগ– ইডি, সিবিআইয়ের মতো তদন্তকারী সংস্থা আপনাদের জোটসঙ্গী। আপনারা এসব এজেন্সির শক্তিকে অপব্যবহার করছেন!
যত তদন্ত চলছে, সেগুলি কবে থেকে চলছে! অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বাদ দিলে কংগ্রেসের উপর যা তদন্ত চলছে, সব তো তাদের সময়ে শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা নিজের মতো কাজ করছে। কংগ্রেস ও বাকি বিরোধী দলের তো এটা বলা উচিত যে, রেকর্ড সময়ের মধ্যে তদন্ত করে আদালত নির্দেশ দিয়ে দিক। সেটা তো একবারও বলে না। কেন তারা সবকিছু ঝুলিয়ে রাখতে চায়। তারিখ-পে-তারিখ চেয়ে সময় নষ্ট করে কেন। কেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল বারবার ইডি-র সমনের পরেও তাদের সামনে হাজির হননি। ছ’-মাস তিনি নিজে নষ্ট করেছেন। এত দিনে তো তদন্ত সম্পূর্ণ হয়ে যেত উনি সহযোগিতা করলে। ইডি বাড়িতে গিয়েছে তখনও সহযোগিতা করেননি। এখন জেলেও করছেন না। এমন নেতা প্রথম দেখলাম, যিনি জেলেও মিষ্টি খেয়ে খুশি হচ্ছেন।
সর্বত্র আলোচনা চলছে, বিজেপি কোথায়! সবকিছুই তো মোদিময়। বিজেপি যেন সব জায়গা থেকেই মিসিং। এমনকী, আপনাদের যে ইস্তেহার সেটাই মোদি-র নামে। এমন আগে তো দেশে দেখা যায়নি যে, ইস্তেহার কারও নামে হচ্ছে!
এতে খারাপ কী! বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় নেতা নরেন্দ্র মোদি। উনি আমাদের শক্তি। আর, সবার উচিত নিজের ক্ষমতার উপরে খেলা। আমি তো মন খুলে বলি, মোদির নামে ভোট চাইছি। আর নরেন্দ্র মোদি তো ভারতীয় জনতা পার্টির কর্মী হিসাবেই কাজ শুরু করে এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা বিজেপিতেই সম্ভব। যখন সারা বিশ্ব নরেন্দ্র মোদির উপর প্রত্যাশা করে বসে রয়েছে, তখন বিজেপি কেন প্রত্যাশা করবে না!
নির্বাচনী বন্ড নিয়ে বিরোধিরা বিজেপির দিকে আঙুল তুলছে। চঁাদা দাও, ব্যবসায়িক সুবিধা নাও– এমন কথা শোনা গিয়েছে! এমন কিছু কোম্পানি রয়েছে যাদের উপর ইডি-র রেড হওয়ার পরে তারা বিজেপিকে চঁাদা দিয়ে ‘ছাড়’ পেয়েছে বলা হচ্ছে!
স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের ‘মডেল’ ছিল দলের উপর পরিবারে কবজা ও দলের চঁাদার উপরেও কবজা। যত টাকা আসত, তার কিছু টাকা পার্টিতে যেত, বাকি টাকা যেত পরিবারের অ্যাকাউন্টে। অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলেও সেই একই ব্যবস্থা চলত। সেখানে পরিবারই পার্টি, আর পার্টিই পরিবার। একশো টাকা এলে দশ-পনেরো টাকা পার্টিতে যেত। বাকি টাকা বাড়িতে, পরিবারে। মোদিজি বললেন, চেকে টাকা আসবে, এবং পার্টির অ্যাকাউন্টেই আসবে। তখন সবার পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। কিছুই তো আর খেয়ে ফেলা যাচ্ছে না! তাই এর বিরোধিতা হচ্ছে। নইলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল একটা রাজ্যে থেকে ১,৬০০ কোটি টাকা পেয়েছে। বিজেপি তথা এনডিএ দেশের আঠারোটি রাজ্য থেকে পেয়েছে ৬,৪০০ কোটি টাকা! ২০১৪ সালের আগে তো দেশের লোক জানতই না কে কত চঁাদা পেয়েছে। এখন তো দেশের লোক সব জানতে পারছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নির্বাচনী বন্ড অনেক বেশি সাফ এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। তবে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। আগামী দু’-তিন বছরে সবার কী অভিজ্ঞতা হয় দেখা যাক। তিন বছর পরে আপনাদের জিজ্ঞাসা করব– কত দল কত টাকা পেয়েছে। কে দিয়েছে, কাকে দিয়েছে, কত টাকা দিয়েছে। হয়তো আপনারা বলতে পারবেন।
‘ইন্ডিয়া’ জোট হওয়ার জন্য আপনাদের কতটা চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে?
এদের কবে ‘জোট’ হল! দিল্লিতে আপ কংগ্রেসের সঙ্গে গিয়েছে। পাঞ্জাবে কেন একসঙ্গে নেই? ওখানে তো মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান বলছেন, সবথেকে বড় চোর কংগ্রেস। এদের সঙ্গে কী করে হাত মেলাব? আর, পাঞ্জাবের বর্ডার পার করে দিল্লিতে এসেই গলাগলি শুরু! কেজরিওয়ালজি তো রাজনীতিতে আসার সময়ে বলেছিলেন– বিজেপির সঙ্গেও যাব না, কংগ্রেসের সঙ্গেও যাব না। গেলেন তো কংগ্রেসের সঙ্গে! মানুষ বিরোধীদের বিশ্বাস করে না। একটা কথা বলি। প্রায় এক কোটি নতুন ভোটার এবার ভোট দেবেন। অনেক দেশের তো জনসংখ্যা-ই তো এত নয়। যুব প্রজন্মের কাছে আমার আবেদন– ভোট দিন দেশের স্বার্থে। মনে রাখবেন, দেশের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা জরুরি। ভারতীয় জনতা পার্টি এবং নরেন্দ্র মোদি তা দিতে পারবেন মানুষকে।